একাত্তরের নভেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। আজ পড়ুন নোয়াখালীর কাহিিন
৬ ডিসেম্বর দুপুরের খাবার খেতে খেতে রেডিওতে ভারতের আকাশবাণী কলকাতার খবর শুনছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক বাদল। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভারী কণ্ঠ জানাচ্ছিল দেশের নানা জায়গায় হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর। আরও জানাল, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারত। খবর শুনে আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন ফজলুল হক ও তাঁর সহযোদ্ধারা। তাঁদের সেই উল্লাসধ্বনিতে নোয়াখালীর কবিরহাটের কালামুন্সীরহাটের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দুপুরের নীরবতা ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
৬ ডিসেম্বর দুপুরেই বৃহত্তর নোয়াখালীর বিএলএফ-প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত বার্তা পাঠান ফজলুল হকের কাছে: হামলার পরবর্তী লক্ষ্য মাইজদী। মুক্তিসেনাদের হামলার মুখে টিকতে না পেরে আগের দিন ৫ ডিসেম্বর রাজাকারদের ফেলে রেখে পিঠটান দিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী। পরিত্যক্ত রাজাকাররা এখন শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে মাইজদীতে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মাইজদী শহর শাখার আহ্বায়ক ছিলেন ফজলুল হক। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মাহমুদুর রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী রাত ১০টার দিকে তাঁরা কালামুন্সীরহাট থেকে যাত্রা করেন। রাজাকারদের চোখ এড়াতে রাস্তা ছেড়ে খেতের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছিলেন তাঁরা। কবিরহাটের পশ্চিমে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় মাহমুদুর রহমানের। সেখানে আরও কয়েকটি ইউনিটের মুক্তিযোদ্ধারা একত্র হন। ছক কষেন চূড়ান্ত আক্রমণের।
৬ ডিসেম্বর রাত তিনটা থেকে মাইজদী শহরের বিভিন্ন স্থানে রাজাকারদের ক্যাম্পে চলে সাঁড়াশি আক্রমণ। অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় সব ক্যাম্প মুক্তিসেনাদের দখলে চলে আসে। কিন্তু পিটিআইতে অবস্থানকারী রাজাকাররা মরিয়া লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।
ওদিকে রাত তিনটার পর ফজলুল হক তাঁর ইউনিটের সদস্যদের নিয়ে মাইজদী শহরের নাহার বিল্ডিংয়ে রাজাকারদের ঘাঁটিতে হামলা চালান। একপর্যায়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় সেখানকার রাজাকাররা। ৭ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে জিলা স্কুলের সামনে রাস্তার পাশের দোকানে ওত পেতে থাকা রাজাকাররা তাঁদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় শত্রুপক্ষের গুলিতে একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও একজন আহত হন। তাঁরা পাল্টা হামলা চালিয়ে কয়েকজন রাজাকারকে আটক করেন। এরপর তাঁরা রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটি মাইজদী পিটিআইয়ের দিকে অগ্রসর হন।
কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধা ঘিরে ফেলেন পিটিআই চত্বর। থেমে থেমে চলতে থাকে গোলাগুলি। এ সময় রাজাকারদের গুলিতে নিহত হন পাঁচ বেসামরিক লোক। আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। হামলায় কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। তীব্র আক্রমণের মুখে বিকেলের দিকে ৬ জন মিলিশিয়া ও ২২ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
শত্রুমুক্ত হয় নোয়াখালী। বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে হাজারো মুক্তিকামী জনতা। শহরের কোর্ট বিল্ডিংয়ে ওড়ানো হয় জাতীয় পতাকা।
ফেনীর বিলোনিয়ার দিক থেকে সহযোদ্ধাদের নিয়ে এগিয়ে আসছিলেন জাফর ইমাম বীর বিক্রম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মাইজদী যাওয়ার পথে বেগমগঞ্জের টেকনিক্যাল স্কুলের সামনে রাজাকারদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন তাঁরা। সেখানে ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে পরাজয় ঘটে রাজাকারদের। ততক্ষণে মাইজদী মুক্ত হয়ে গেছে। তাই তাঁরা সেখান থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন নোয়াখালী প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান}