রাজধানীর আজিমপুর মসজিদের খাদেম মো. হানিফ শেখ (৩০) হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাইফুল ইসলামকে (৩৮) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গতকাল সোমবার চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছে পিবিআই।
গত বুধবার আজিমপুর কবরস্থান জামে মসজিদের বারান্দা থেকে প্রধান খাদেম মো. হানিফের বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় হানিফের শ্বশুর মো. জাকির শেখ (৬০) বাদী হয়ে সাইফুল ইসলামসহ চারজন এবং অজ্ঞাতনামা আরও দুই থেকে তিনজনের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এ ঘটনার পর থেকে সাইফুল ইসলাম পলাতক ছিলেন। গতকাল তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআইয়ের উপমহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, আজিমপুর পুরোনো কবরস্থান মেয়র মোহাম্মদ হানিফ জামে মসজিদের প্রধান খাদেম ছিলেন সাইফুল। কাজে ফাঁকি দেওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাঁকে পছন্দ করত না। সম্প্রতি তাঁর স্থলে মো. হানিফ শেখকে প্রধান খাদেম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পদ ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া সাইফুল মো. হানিফ শেখকে খুন করার পরিকল্পনা করেন।
বনজ কুমার মজুমদার জানান, মসজিদ কর্তৃপক্ষ গত বছর ৪ নভেম্বর হানিফকে নিয়োগ দেন। হানিফসহ এ মসজিদে তিনজন খাদেম ও একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী ছিলেন। সাইফুলকে বিভিন্ন কাজের নির্দেশ দিতেন হানিফ। এ নিয়ে সাইফুলের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে গত বুধবার হানিফের কথামতো কাজ করবেন না বলে জানিয়ে দেন সাইফুল। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়।
ওই দিন জোহরের নামাজের পর হানিফ খেয়েদেয়ে দোতলায় তাঁর নিজের কক্ষের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েন। এই সুযোগে সেই কক্ষের দরজা লাগিয়ে সাইফুল রান্নাঘর থেকে একটি চাকু এনে হানিফের পেটে পরপর দুবার আঘাত করেন। হানিফ জেগে উঠলে তাঁর মুখ চেপে ধরে বুক, পেট ও গলায় ১১টির মতো আঘাত করেন।
হানিফের মৃত্যু নিশ্চিত করে সাইফুল প্লাস্টিকের বস্তা ও পলিথিন নিয়ে আসেন। মৃতদেহ বস্তায় ঢুকিয়ে পলিথিন দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে ব্যালকনিতে একটি বাঁশের ঝুড়িতে রেখে দেন। বাথরুম থেকে বালতিতে পানি এনে তোশকের কভার ভিজিয়ে ফ্লোরের রক্ত পরিষ্কার করেন। এরপর সাইফুল আসরের নামাজ আদায়ে যান। নামাজ শেষে সাইফুল তাঁর ব্যবহৃত রক্তমাখা কাপড় বাথরুমে পরিষ্কার করেন।
রাত নয়টার দিকে সাইফুল বাইরে খেতে গিয়ে ১০টার মধ্যে রুমে ফিরে আসেন। ঝাড়ুদার বাহাউদ্দিন ও নতুন খাদেম ফরিদ বাইরে থেকে মসজিদে এসে খাদেম হানিফ কোথায় আছেন—সাইফুলকে জিজ্ঞেস করেন। সাইফুল জানান, হানিফ বাইরে গেছেন। সাইফুলের পরিকল্পনা ছিল, গভীর রাতে খাদেম হানিফের লাশ আজিমপুর কবরস্থানের কোনো একটি ভাঙা কবরে ফেলে দেবেন। কিন্তু খাদেম ফরিদ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকায় সাইফুল তাঁর সিদ্ধান্ত বদলান।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাইফুল খাদেম ফরিদকে জানান, তাঁর বাবা মারা গেছেন। এই বলে সাইফুল তাঁর সব ব্যবহার্য জিনিস নিয়ে চলে যান। গত বুধবার রাতে ক্লিনার বাহাউদ্দিন ও নতুন নিয়োগকৃত খাদেম ফরিদ নিহত খাদেম হানিফের কক্ষে ঘুমাতে যান। সেই সময় তাঁরা দুর্গন্ধ পেয়ে পাশের ব্যালকনির থাই গ্লাস টান দিয়ে একটি বাঁশের খালি ঝুড়ির মধ্যে পলিথিন দিয়ে প্যাঁচানো একটি বস্তা দেখেন। সেটি খুলে তাঁরা খাদেম হানিফের লাশ শনাক্ত করেন।
সাইফুল পালিয়ে প্রথমে সেনবাগ নোয়াখালী তাঁর বাবার বাড়িতে যান। পরে সেখান থেকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রামের খুলশীতে গিয়ে আশ্রয় চান। তাঁর শ্বশুর আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানালে রেলওয়ে হাসপাতালে চাচার কাছে যান। সেখানে আশ্রয়ের সুযোগ না পাওয়ায় আগ্রাবাদ বেপারীকান্দি এলাকায় তাঁর ফুপুর কাছে আশ্রয় নেন সাইফুল। সেখানেই আত্মগোপন করেন তিনি।
পিবিআইয়ের একটি দল সাইফুলের ফুফুর বাসার দরজা ভেঙে দেখতে পায়, সাইফুল দাঁড়ি কামানো অবস্থায় খাটে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। খাদেম হানিফ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রক্তমাখা চাকুটি ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। জবানবন্দি দিতে সাইফুলকে আজ আদালতে পাঠানো হয়েছে।