মরতে বসেছে মইয়ার হাওর

পলান সরকার (জন্ম: ১৯২১, মৃত্যু: ১ মার্চ ২০১৯)। ফাইল ছবি
পলান সরকার (জন্ম: ১৯২১, মৃত্যু: ১ মার্চ ২০১৯)।  ফাইল ছবি

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের মইয়ার হাওর। একটা সময়ে বোরো আবাদ হতো এখানে। বছরের এই সময়টায় সবুজের সমারোহে চোখ জুড়িয়ে যেত। এখন সেসব শুধুই অতীত। যত দূর চোখ যায়, শুধুই বালুময় ভূমি। মাঝেমধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আবাসিক ভবন। এলাকাবাসী বলছে, ২০ বছর আগে হাওরের ভেতর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়। এতে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাওরটি ধীরে ধীরে মরতে বসেছে।
জগন্নাথপুর শহর থেকে আধা কিলোমিটার দূরে মইয়ার হাওরের অবস্থান। নলুয়ার হাওর এই উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বড়। আয়তনের দিক থেকেই নলুয়ার হাওরের পরই অবস্থান মইয়ার হাওরের। পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় হাওরটি এখন চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় এবং এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মইয়ার হাওর এলাকার বেশির ভাগ মানুষ কৃষক। হাওরের জমিতে বছরে একটি ফসল হয়। এই বোরো আবাদ করে মানুষ যে ধান ঘরে তোলেন, সেটা দিয়েই বলতে গেলে পুরো বছর চলে। কিন্তু দুই দশক ধরে হাওরটি ক্রমেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ভরাট হতে হতে বর্তমানে বেশির ভাগ এলাকা চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে এলাকার কৃষকদের এখন দৈন্যদশা।
ইকড়ছই গ্রামের কৃষক মতিউর রহমান বলেন, ‘মইয়ার হাওরে আমাদের জমি ছিল ১০ কেদার (৩০ শতকে এক কেদার)। জমিগুলো পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। ওই জমিতে আমরা আর বোরো আবাদ করতে পারছিলাম না। ফলে বাধ্য হয়ে কম দামে ছয় কেদার জমি বিক্রি করে দিয়েছি। কিছু জমিতে এখন আবার আবাসিক ভবন গড়ে উঠছে।’ ঘোষগাঁও গ্রামের কৃষক সুলতান আলী বলেন, ‘হাওরে জমি থাকলেও আমরা আজ নিঃস্ব। কারণ পলি-বালু পড়ে জমি ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন সেখানে আর কোনো ফসল ফলাতে পারছি না।’

এলাকাবাসী বলছে, ১৯৯৮ সালে মইয়ার হাওরের কৃষিজমির ওপর দিয়ে সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এ সড়কটি গেছে জগন্নাথপুর উপজেলা সদর থেকে উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়ন হয়ে। পরে সড়কটি আউশকান্দি এলাকায় গিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মিশেছে। ফলে সুনামগঞ্জবাসীর ঢাকায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে ৯০ কিলোমিটার দূরত্ব কমেছে, এটা ঠিক। কিন্তু সড়কের কারণে হাওরের পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। বিভিন্ন বিল পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। সড়কের পাশে উঠতে থাকে ভবন। বর্তমানে জগন্নাথপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটারজুড়ে হাওরের জমি আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। ঠিকমতো চাষাবাদ না হওয়ায় অনেকেই জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। বেশির ভাগ ক্রেতা সেসব জমিতে ঘর তুলেছেন।

জগন্নাথপুর উপজেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি নুরুল হক বলেন, মইয়ার হাওরের ভেতর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছিল এলাকাবাসীর স্বার্থেই। কিন্তু সেই সড়কের কারণেই হাওরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়কটি গেছে হাওরের ব্রাহ্মণদাইড় বিলের ভেতর দিয়ে। পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে ওই বিলের আর অস্তিত্বই নেই।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাসুদ জামান বলেন, মইয়ার হাওরের ভেতরে পাঁচটি বড় বিল ছিল—চাতল বিল, কাংলা বিল, বড়ডহর বিল, ইকড়দাইড় বিল ও ব্রাহ্মণদাইড় বিল। বিলগুলোর অস্তিত্ব এখন খাতা–কলমে। সব বিল ভরাট হয়ে গেছে। আগে বছরের চার-পাঁচ মাস পানির প্রবাহ ছিল। এখন ভরা বর্ষায়ও বদ্ধ। খালগুলো খনন করা গেলে সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে। এ বিষয়ে তাঁরা একটি প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবেন।
কৃষকদের অভিযোগ, মইয়ার হাওরের বিলগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় জমিতে চাষাবাদের জন্য পানির সংকট দেখা দেয়। ফলে কৃষকেরা ধীরে ধীরে চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থায় ক্রমেই হাওরটি বালুময় পতিত জমিতে রূপ নিয়েছে। এই সুযোগে অনেকেই হাওরটিতে বসবাসের ঘর তুলেছেন।
হবিবনগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, যত দূর চোখ যায় শুধুই পতিত জমি। মাঝেমধ্যে আবাসিক স্থাপনা। পতিত জমির প্রায় পুরোটায় বালুময়। হাওরের মধ্যে চর জেগেছে। অনেক স্থান থেকে মানুষ বালু তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার বলেন, ‘মইয়ার হাওরটি পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। এ কারণে এখন হাওরে চাষাবাদের যোগ্য জমির পরিমাণ কমে গেছে। এখন যতটুকু চাষাবাদের যোগ্য জমি রয়েছে, সেগুলোকে চাষাবাদের আওতায় রাখতে কৃষকদের আমরা সহায়তা করে যাচ্ছি।’
কৃষি বিভাগ সূত্র বলছে, মইয়ার হাওরে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে। তার মধ্যে ২ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে এখন বোরো আবাদ হচ্ছে। হাওরের কিছু অংশে আশপাশের খাল থেকে পাইপে করে পানি এনে চাষাবাদ হচ্ছে। আবার হাওরের নিচু অংশে কমবেশি পানি পাওয়া যায়। হাওরের বাকি জমিগুলো সারা বছরই অনাবাদি থেকে যাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারী প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন বলেন, ‘পলি পড়ে বালুময় পতিত জমিতে পরিণত হওয়ায় মইয়ার হাওরটি অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। তাই এ হাওরে আমরা নলুয়ার হাওরের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ করেছি।’
জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহফুজুল আলম বলেন, ‘মইয়ার হাওরটিকে চাষাবাদযোগ্য করে রাখতে কৃষি বিভাগকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। কৃষিজমিতে যাতে কোনো আবাসিক স্থাপনা গড়ে না ওঠে, আমরা সেভাবে পদক্ষেপ নেব।’