করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্থানীয় ও বিদেশি নাগরিকেরা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আর আক্রান্ত অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। আক্রান্ত এসব লোকজনের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিকেরাও রয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বাংলাদেশিরা মারা গেছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন কিংবা কোয়ারেন্টিনে আছেন। আবার কয়েকটি দেশে কেউ আক্রান্ত হননি। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে লকডাউন, সান্ধ্য আইনসহ কঠোর ব্যবস্থার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে অভিবাসী শ্রমিকেরা খাবারের সংকটে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে এঁদেরকে মধ্যপ্রাচ্যের বাংলাদেশ মিশন ও প্রবাসী বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের সহায়তায় খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও কুয়েতে এখন পর্যন্ত ২৬ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। এঁদের মধ্যে সৌদি আরবে ১৫ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৬ জন, কাতারে ৪ জন ও কুয়েতে মারা গেছেন ১জন। আর এসব দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২০০ বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়েছেন। কাতারে প্রায় এক হাজার, সৌদি আরবে প্রায় ১০০ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৬০ জনের মতো আক্রান্ত হয়েছেন ।
তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বাহরাইন, জর্ডান, ইরাক, ওমানে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে বাংলাদেশিদের আক্রান্তের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
সৌদি আরব
সৌদি আরবে বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রিয়াদ থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, গত সপ্তাহ পর্যন্ত এখানে ১৫ জন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছেন। আর আক্রান্ত লোকজনের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিক ৮৫ থেকে ১০০ জন বলে জানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এঁদের মধ্যে জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের শ্রম কাউন্সেলরও রয়েছেন।
গোলাম মসিহ জানান, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের কর্মীদের মধ্যে খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে রিয়াদের দূতাবাস ও জেদ্দা কনসুলেটের নিজস্ব তহবিল থেকে তাঁদের জন্য খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য জরুরি সহায়তা নিশ্চিত করতে সৌদি আরবে অবস্থানরত বিশিষ্ট বাংলাদেশিসহ এখানকার কমিউনিটি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।
কাতার
কাতারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে দেখা গেছে, প্রতিদিনই কাতারে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সোমবার থেকে টানা তিন দিনই সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা পাঁচ শতাধিক ছিল। যদিও এখন পর্যন্ত কাতারে ১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিক ৪ জন।
কাতার থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আশুদ আহমেদ গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত ৪ বাংলাদেশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছেন। আর সংক্রমিত হওয়া লোকের সংখ্যা এক হাজারের মতো হতে পারে। যদিও এ মাসের ৭ তারিখের পর থেকে করোনাভাইরাসে কত বাংলাদেশি সংক্রমিত হয়েছেন, সে তথ্য আর জানায়নি কাতার। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্তত ৫০০ নাগরিক সংক্রমিত বলে জানিয়েছিল কাতার।
আশুদ আহমেদ জানান, বৃহস্পতিবার থেকে মধ্য কাতারের আল-সাহানিয়া ধীরে ধীরে লকডাউনের আওতামুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শহরটিতে আক্রান্ত লোকজনের অধিকাংশই অভিবাসী শ্রমিক। ওই শহরে অন্তত ৩০ হাজার বাংলাদেশি কাজ করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, এ মুহুর্তে কাতারে কাজ করছেন ৪ লাখ ১৬ হাজার বাংলাদেশি। এঁদের মধ্যে ফ্রি ভিসা অর্থাৎ নির্ধারিত কাজ ছাড়াই দেশটিতে যাওয়া বাংলাদেশের কর্মীদের সংখ্যা ৩০ হাজারের কম নয়। গাড়ি চালানো, দোকানে কাজ করাসহ নানা রকম অনিয়মিত শ্রমের সঙ্গে যুক্ত এসব কর্মী লকডাউনের কারণে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছেন তাঁদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সম্প্রতি দূতাবাস ফ্রি ভিসায় কাতারে অবস্থানরত কর্মীদের অনলাইনে নিবন্ধিত হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। গত তিন দিনে ফ্রি ভিসায় যাওয়া অন্তত সাত হাজার কর্মী নিজেদের নাম নিবন্ধন করেছেন দূতাবাসে। ফলে রোজার মাসসহ সামনের দিনগুলোতে তাঁদের খাবারের ব্যবস্থার ওপর দূতাবাস জোর দিচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত আশুদ আহমেদ বলেন, এখন পর্যন্ত দেড় হাজার লোকের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে তা অব্যাহত থাকবে। এর মধ্যেই দূতাবাসের নিজস্ব তহবিলের পাশাপাশি কাতার চ্যারিটির সহায়তা নিচ্ছে। পাশাপাশি কাতারে অবস্থানরত বাংলাদেশ কমিউনিটির বিশিষ্টজন ও সচ্ছল প্রতিনিধিদের যুক্ত করে সংকটে পড়া লোকজনকে সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
আবুধাবিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৬ জন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছেন। আর আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়ে গেছে।
মিজানুর রহমান জানান, এ মুহুর্তে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাত লাখের মতো বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। বাংলাদেশের কর্মীদের মধ্যে খাদ্যসংকট দেখা দিলেও প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে মিশনের সহায়তায় লোকজনের মধ্যে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশিকে খাদ্য সরবরাহ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় বাংলাদেশি সম্প্রদায়ও পাঁচ হাজার অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য খাদ্যদ্রব্য দিয়েছে।
বিভিন্ন দেশে মৃত্যু ৩১৮
মধ্যপ্রাচ্যের ৪টি দেশে ২৬ জনসহ এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৩ দেশে ৩১৮ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯০, যুক্তরাজ্যে ৭৯, ইতালিতে ৮, কানাডায় ৬, স্পেনে ৫ এবং সুইডেন, কেনিয়া, লিবিয়া ও গাম্বিয়ায় ১ জন করে সব মিলিয়ে ৩১৮ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন।