প্রাথমিকে সমাপনী পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা
প্রাথমিকে সমাপনী পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা

মতামত উপেক্ষা, স্থায়ী করার চিন্তা

■ ২০০৯ সাল থেকে সমাপনী পরীক্ষা শুরু।

■ প্রতিবছর গড়ে পরীক্ষার্থী থাকে প্রায় ৩০ লাখ।

■ করোনার কারণে এ বছর সমাপনী পরীক্ষা হচ্ছে না।

‘প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ড’ করতে চায় মন্ত্রণালয়। সমাপনী পরীক্ষা বন্ধ করতে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে গণসাক্ষরতা অভিযান।

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপের সৃষ্টি করছে, তাই এই পরীক্ষা বাদ দেওয়া দরকার—শিক্ষাবিদ, শিক্ষাবিষয়ক গবেষক ও অভিভাবকদের বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে এ কথা বলে আসছে। তারা বলছে, শিশুদের এই পরীক্ষা মুখস্থনির্ভরতা, গাইড বই অনুসরণ, কোচিং বাণিজ্য ও পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের প্রসার ঘটিয়েছে। সরকারের করা জাতীয় শিক্ষানীতিতেও পঞ্চম শ্রেণিতে জাতীয়ভাবে পরীক্ষা নেওয়ার কথা নেই।

কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতামতকে উপেক্ষা করে এই পরীক্ষাকে স্থায়ী রূপ দিতে চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ জন্য ‘প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ড’ করার চিন্তাভাবনা করছে মন্ত্রণালয়। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় এই পরীক্ষা।

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেছেন, বিষয়টি (প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ড করা) এখন পর্যন্ত আলোচনায় আছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

২০০৯ সালে হঠাৎ করেই জাতীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে সরকার। প্রথমে শুধু সাধারণ ধারার শিক্ষায় এটি সীমাবদ্ধ ছিল। পরে মাদ্রাসার ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী (পঞ্চম শ্রেণির সমমান) পরীক্ষাও চালু করা হয়। এখন প্রতিবছর প্রায় ২৯–৩০ লাখ শিক্ষার্থী এই দুই পরীক্ষায় অংশ নেয়। অবশ্য করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এ বছর এই পরীক্ষা হচ্ছে না।

২০১০ সালে করা জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, পঞ্চম শ্রেণি শেষে উপজেলা বা পৌরসভা বা থানা পর্যায়ে সবার জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু অন্য অনেক কিছুর মতো শিক্ষানীতির এই সিদ্ধান্তও মানা হয়নি। এমনকি শিক্ষানীতিতে থাকা প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার সিদ্ধান্তও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি।

শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের ২০১৫ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দেশের ৮৬ দশমিক ৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয়। আবার ৭৮ শতাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে এই পরীক্ষার জন্য কোচিং ছিল বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া এই পরীক্ষার জন্য প্রাইভেট পড়ার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে, পাঠ্যবইকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে গাইড বই। এই পরীক্ষা ভালোর পরিবর্তে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য বাড়তি ‘চাপ ও সমস্যা’ হিসেবে হাজির হয়েছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ। তিনিও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেওয়ার পক্ষে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বিষয়টি নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার। জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নের (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট) মতো কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। এ জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

‘প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ড’ করার পরিকল্পনার পর গণসাক্ষরতা অভিযান গত ২০ অক্টোবর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনকে চিঠি দিয়ে এই পরীক্ষা বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, গণসাক্ষরতা অভিযান সম্প্রতি ঢাকার বাইরে আটটি এলাকায় অংশীজনদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে আটটি সভা করে। এতে শিক্ষক, অভিভাবক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য এবং উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানেও শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষকদের ওপর অহেতুক চাপ কমানো এবং কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টানার লক্ষ্যে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বন্ধের জোরালো প্রস্তাব এসেছে। সংস্থাটি বলেছে, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী করা হলে সেটি হবে একটি পশ্চাৎমুখী ও নেতিবাচক পদক্ষেপ।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো–চেয়ারম্যান খলীকুজ্জমান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাটি কোনোভাবেই উপকারী নয়; বরং এই পরীক্ষার মাধ্যমে একটি ব্যবসার জায়গা তৈরি হয়েছে। কোচিং-প্রাইভেটের কারণে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ, সামর্থ্যবান বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের জন্য আলাদা শিক্ষক রেখে দিচ্ছেন। অন্যদিকে গরিব পরিবারের সন্তানেরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার বেড়াজালে পড়ে গেছে। এ জন্য অন্তত পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাটি বাদ দেওয়া দরকার।