ভয় দেখানোর যন্ত্র ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

লেখক মুশতাক ‘হত্যার’ তদন্ত ও বিচার, গতকালের ‘হামলার’ বিচার এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে দুপুরে শাহবাগে বিক্ষোভ করছে বাম ছাত্রসংগঠনগুলো
ছবি: সাজিদ হোসেন

দেশে একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। ভয় দেখানোর যন্ত্র হিসেবে এই আইন ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন কেউ কিছু লিখতে বা বলতে গেলে আগে মুশতাক আহমেদের পরিণতির কথা স্মরণ করবে। সাংবাদিকতা, মুক্তমত চর্চা ও কথা বলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা এই আইন। পথ একটাই—এই আইন বাতিল করতে হবে।

আজ শনিবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) অনলাইনে ওই আলোচনার সভার আয়োজন করে। এই আইনে করা একটি মামলায় কারাগারে থাকা অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু হয়।

মানুষ কি রাষ্ট্রের সমালোচনা করতে পারবে না

আলোচনায় অংশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনীতির বাইরে গিয়ে আইন তৈরি হয় না। এই আইন করা হয়েছিল জাতীয় নির্বাচনের আগে। এরপর নির্বাচন কীভাবে হয়েছে, আদৌ নির্বাচন হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই আইন তৈরি করা হয়েছে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য। কে কোনটা লিখবে আর লিখবে না, সে বিষয়ে সরকারকে কিছু বলতে হবে না। লেখার আগে প্রতিবার মানুষ স্মরণ করবে মুশতাকের কথা। এটাই বাস্তবতা। তিনি বলেন, শক্তিনির্ভরতা ও বলপ্রয়োগ–নির্ভরতার কারণে ভয়ের সংস্কৃতি প্রয়োজন। এই আইনের মাধ্যমে ‘সেন্সরশিফ ফ্র্যাঞ্চাইজ’ করা হয়েছে। এই আইন করে আইনের শাসনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে।

আলী রীয়াজ বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে অভিযুক্ত একজন ব্যক্তি কারাগারে মারা গেলেন। বারবার তিনি জামিন চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এই আইনে জামিন–অযোগ্য ধারাই বেশি। কয়েকটি ধারা ছাড়া প্রায় সব কটি ধারাই জামিন–অযোগ্য। যদি এটাই হয়, তাহলে বিচারিক আদালতের ভূমিকা আর কী থাকল এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, এমন নয় যে ব্যক্তি খুনের মামলার আসামি। শুধু কথা বলার কারণে আপনাকে এমন ধারায় আটক করা হবে, যা জামিন–অযোগ্য।
আলী রীয়াজ বলেন, সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ‘সংসদ সদস্যদের মানসম্মান রক্ষার জন্য এই আইন’। কারও কারও জন্য কি আলাদা কোনো আইন করা যায়? সংবিধান তো বলে, আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান।

রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা—এই আইনে এ ধরনের অনেকগুলো বিষয় অস্পষ্ট উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি হতে পারে না। মানুষ কি রাষ্ট্রের সমালোচনা করতে পারবে না?

ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক দেশ প্রমাণ করে না উল্লেখ করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এই আইনের কোনো অপপ্রয়োগ হচ্ছে না, প্রয়োগই হচ্ছে। সাংবাদিকতা, মুক্তমত চর্চা ও কথা বলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা এই আইন। পথ একটাই—এই আইন বাতিল করতে হবে। তিনি বলেন, সংস্কারের কথা শুনলে ভয় হয়। আগে আইসিটি অ্যাক্ট ছিল। সেটা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ছিল। পরে বাতিল করে এই আইন করা হয়েছে, যা আরও ভয়াবহ। উত্তরণের উপায় হলো রাজনীতি ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। রাষ্ট্র, দল, প্রশাসন আলাদা করা।

সব কালো আইনের মা এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

আর্টিকেল নাইনটিনের আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন, মতপ্রকাশের জন্য একজনকে জীবন দিতে হলো। এটা অশনিসংকেত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আইসিটি আইনের ধারাগুলোই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে; বরং আরও কঠিন করা হয়েছে। জনগণের নিরাপত্তা নয়, একটি দল, একটি পরিবার এবং তাদের সমর্থকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই আইন। যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই, সেসব দেশে মুখ চেপে ধরার জন্য এ ধরনের আইন করা হয়। দেশে যত কালো আইন আছে, সেসবের মা হলো এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইন হওয়ার আগে সাংবাদিকদের শারীরিক নির্যাতন বেশি হতো। এখন আইনি হয়রানি বেড়ে গেছে। এই আইনের অতিব্যবহারে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যতগুলো মামলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত একটিও নিষ্পত্তি হয়নি। ভয় দেখানোর যন্ত্র হিসেবে এই আইন ব্যবহৃত হচ্ছে।


উদ্ভটতম দেশের উদ্ভট আইন

আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, তিনি আশা করেন, মুশতাকের মৃত্যু নতুন দিনের সূচনা করবে। এই মৃত্যু বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, দুনিয়ার কোথাও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপরাধ ফৌজদারি আইনে নেই। ১৮৫০ সালের আগে এটি ছিল। অপপ্রয়োগের কারণে এটি তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন শুধু রাজা–বাদশাদের দেশে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপরাধ ফৌজদারি আইনে বিচার হয়। দুনিয়ার কোথাও এ ধরনের বাক্স্বাধীনতা খর্বকারী আইন নেই।


শাহদীন মালিক বলেন, শাসকেরা তাদের বৈধতা নিয়ে সংশয়ে আছে, তাদের জনপ্রিয়তা যদি কমে যায়—সে ভয় থেকে এসব করা হয়েছে। উদ্ভটতম দেশের উদ্ভট আইন। অবিলম্বে এটি বাতিল করতে হবে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের সুবুদ্ধির উদয় হবে, তা তিনি আশা করেন না। যদি কখনো গণতান্ত্রিক সরকার আসে, তাহলে এই আইন বাতিল হবে।

ত্রুটি থাকলে তদন্ত করে উপযুক্ত বিচার করা উচিত


মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, মুশতাক আহমেদের মৃত্যু অনভিপ্রেত। মৃত্যুর ঘটনা খতিয়ে দেখে কারও অবহেলা বা ত্রুটি থাকলে তদন্ত করে উপযুক্ত বিচার করা উচিত। সরকার বিচারহীনতা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তিনি আসামি অবস্থায় মারা গেছেন। এ রকম মৃত্যু অনেক হচ্ছে। এমন নয় যে তাঁকে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় বর্বরোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তখন অনেকের বিবেক তালাবদ্ধ ছিল।

মন্ত্রী আরও বলেন, অধিকার চর্চা করতে গিয়ে অন্যের অধিকার খর্ব করা যাবে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ নেই, তা নয়। এই আইন পর্যালোচনা হতে পারে। সব আইনই সময়োপযোগী করা হয়। আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় অনেক সময় ক্ষুব্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই আইনকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। ভয়ের সংস্কৃতি বলেও দেশে কিছু নেই। কোনো খ্যাতিমান সাংবাদিক বা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি যাঁরা সরকারের সমালোচনা করেন, এমন কারও বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়নি।

শ ম রেজাউল করিম বলেন, শাহদীন মালিক বলেছেন, উদ্ভট দেশে উদ্ভট আইন। তিনি দেশকেই উদ্ভট বানিয়ে ফেললেন। মতপ্রকাশের অধিকার আছে বলেই তিনি এটা বলতে পেরেছেন। তিনি বলেন, শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নয়, অনেক আইনেই জামিন–অযোগ্য ধারা আছে। দুদকের আইন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের প্রায় সব ধারা জামিন–অযোগ্য। আইনে জামিন–অযোগ্য বলা হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিচারকেরা জামিন দিতে পারেন। মুশতাকের জামিন কেন হয়নি, সেটা আদালতের বিষয়। সরকারি দলের অনেক প্রভাবশালী নেতাও জামিন পাননি। তিনি উদাহরণ হিসেবে যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর প্রসঙ্গ টানেন।

সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ জাকিয়া পারভীন খানম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি ভালো পদক্ষেপ। দেশের ভালোর জন্যই এই আইন করা হয়েছে। এটাকে নেতিবাচকভাবে দেখলে দেশের জন্য ভালো কিছু হবে না।

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে নতুন আইন করা প্রয়োজন।

সিজিএসের চেয়ারম্যান মঞ্জুর এ চৌধুরী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেন। তাতে বলা হয়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে ৭৮৩টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সিজিএস ৪০২টি মামলার তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। ৪০২টি মামলায় মোট অভিযুক্ত ৮৭৩ জন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ রাজনৈতিক ব্যক্তি। শিক্ষার্থী আছেন ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ।