টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিশুদের ভাগ্য অনেক ভালো। বয়স দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে দেশের ৮২ শতাংশ শিশু জীবনরক্ষাকারী টিকা পায়। কিছু ক্ষেত্রে এই হার ৯৯ শাতংশ। টিকার এই সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রসংশিত হয়েছে। এর পেছনে আছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআই।
‘আপনার শিশুকে টিকা দিন’ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির এই বিনয়ী আহ্বান সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছেছে। সন্তান জন্ম নেওয়ার আগেই মা–বাবা জেনে নেন শিশুর টিকার নিশ্চয়তা আছে কি না। জন্মের পরপরই তাই শিশু টিকা পেয়ে যায়, পায় সুরক্ষা।
তবে এক দিনে বাংলাদেশে এই পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ।
ইপিআইয়ের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. মওলা বক্স চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের কর্মসূচি ব্যবস্থাপনার কারণে টিকাদানে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে।’
স্বাধীনতার সময় দেশে শিশুর মৃত্যুহার অনেক বেশি ছিল। শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধি। এসব ব্যাধি থেকে শিশুকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে দেশে শুরু হয় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি।
শুরুতে শিশুদের ছয়টি রোগের টিকা দেওয়া হতো। রোগের তালিকায় ছিল যক্ষ্মা, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, পোলিও ও হাম। শুরুর দিকে টিকা দেওয়া হতো হাসপাতালে। টিকা পেত মূলত শহরের শিশুরা। ১৯৮৫ সাল নাগাদ ২ থেকে ৩ শতাংশ শিশু টিকার আওতায় আসে। ওই বছর থেকেই ইউনিভার্সাল চাইল্ডহুড ইমিউনাইজেশন কর্মসূচির মাধ্যমে শহর ও গ্রামের সব শিশুকে টিকা দেওয়া শুরু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০১৯’–এ বিভিন্ন সময়ে হাতে নেওয়া কিছু কর্মসূচির উল্লেখ আছে। যেমন ১৯৯০ সালে ইপিআই সেবা উদ্দিষ্ট সব জনগোষ্ঠীর কাছে নেওয়া শুরু হয়; ১৯৯৫ সালে পোলিও নির্মূল এবং মা ও নবজাতকের ধনুষ্টংকার নির্মূল কর্মসূচি শুরু হয়; ২০০৩ সালে শুরু হয় হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া; ২০১২ সালে এমআর টিকা এবং হামের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয়; ২০১৫ সালের মার্চে পিসিভি ও আইপিভি টিকা দেওয়া শুরু হয়।
সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের কর্মসূচি ব্যবস্থাপনার কারণে টিকাদানে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে।’ডা. মওলা বক্স চৌধুরী, ব্যবস্থাপক, ইপিআই কর্মসূচি
ইপিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বর্তমানে ১০ ধরনের টিকা দেওয়া হয়। ০ থেকে ১০ বছর বয়সী সব শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারণক্ষম সব নারী টিকা কর্মসূচির আওতায় আছে।
টিকা কর্মসূচি মাঠপর্যায়ে কীভাবে পরিচালিত ও বাস্তবায়িত হয়, তার বর্ণনা দিলেন ইপিআইয়ের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মওলা বক্স চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে তিনটি পুরোনো ওয়ার্ডে আটটি করে সাব–ব্লক আছে। অর্থাৎ প্রতিটি ইউনিয়নে ২৪টি সাব ব্লক। প্রতিটি সাব ব্লকে মাসে একবার করে টিকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিটি উপজেলা হাসপাতাল, জেলা ও সদর হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন টিকা দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে সারা দেশে ১ লাখ ২০ হাজার অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্র এবং ৭০০ স্থায়ী টিকাদান কেন্দ্র আছে। প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হয়।
গ্রামের টিকাকেন্দ্রগুলোতে টিকা দেন স্বাস্থ্য সহকারী। তাঁদের কাজ তদারক করেন সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক। আর সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শকদের কাজ তদারকি করেন স্বাস্থ্য পরিদর্শক। তাঁদের ওপরে আছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা। অন্যদিকে শহর এলাকায় বিভিন্ন এনজিও এই কাজ করে। তাদের সহায়তা করে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ ছাড়া শহরের মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে তাঁদের শিশুদের টিকা দেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ২০০১ সাল থেকে টিকার আওতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০০১ সালে ১২ মাস বয়সী ৫২ শতাংশ শিশু টিকার আওতায় আসে। ২০১৯ সালে এই হার ছিল ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ১৮ বছরে টিকার আওতা ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ বিন্দু (পার্সেন্টেজ পয়েন্ট) বেড়েছে। একইভাবে ২৪ মাস বয়সী শিশুদের বিভিন্ন ধরনের টিকা পাওয়ার হারও অনেক বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিসিজি টিকা দেওয়ার হার ৯৯ শতাংশের বেশি।
ইপিআই কর্মসূচির ফলে ২০০৮ সাল থেকে মা ও নবজাতকের ধনুষ্টংকার দূরীকরণ অবস্থা দেশে বজায় রয়েছে। ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে পোলিও নির্মূল সনদ লাভ করে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সাফল্যের পেছনে বেশ কিছু কারণ আছ। কর্মসূচির কর্মকর্তারা আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষকে এই কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন। মাঠকর্মীরা বছরের পর বছর কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গে করে চলেছেন। সারা দেশের টিকাকেন্দ্রগুলো তাঁরা দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেন। তাঁরা নিরাপদে টিকা দেন। এ ছাড়া টিকা ও টিকাদানসামগ্রীর আছে নিয়মিত সরবরাহ। সারা দেশের টিকা রাখার জন্য আছে প্রয়োজনীয় ‘কোল্ড চেইন’। আছে শক্তিশালী নজরদারির ব্যবস্থা। সার্বিকভাবে টিকা কর্মসূচির এই সুফল পেয়েছে বাংলাদেশের শিশুরা।
টিকাদান কর্মসূচিকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বড় ধরনের সাফল্য হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচনা করা হয়। এই সাফল্যের একাধিক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। টিকার ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনের (গাভি) বোর্ড চেয়ার এনগোজি ওখানজো ওয়েলা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে পুরস্কৃত করেন।