ফেনীর পরশুরামের ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার রীতি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। পরশুরাম পৌরসভা নির্বাচনে পরপর দুবার মেয়র ও কাউন্সিলররা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি ফেনী ও দাগনভূঞা পৌরসভা নির্বাচনেও একইভাবে মেয়র পদ ছাড়া কাউন্সিলর পদে ৩৬ জনের মধ্যে ২২ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন।
এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-১ (ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরাম) আসনে জাসদ নেত্রী শিরীন আখতার, ফেনী-২ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নিজাম উদ্দিন হাজারী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে পরশুরাম উপজেলার ৩টিসহ জেলায় ১০ জন চেয়ারম্যান ও বেশ কিছুসংখ্যক ইউপি সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত সবাই বিনা ভোটে নির্বাচিত হন।
অপর দিকে ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও সোনাগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জহির উদ্দিন মাহমুদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন।
স্থানীয় বিএনপির নেতারা বলেছেন, মনোনয়নপত্র জমাদানে বাধা দেওয়া হয়েছে। হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তাঁরা প্রার্থী দিতে পারেননি।
জানতে চাইলে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফেনী সদর আসনের সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারী প্রথম আলোকে বলেন, কাউকে মনোনয়ন জমাদানে বাধা দেওয়া হয়নি। নির্বাচনে পরাজয়ের ভয়েই তাঁরা প্রার্থী হতে সাহস করেননি। এখন মুখ রক্ষার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দোষারোপ করছেন।
নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন পাটওয়ারী বলেন, হুমকি-ধমকি দেওয়ার বিষয়ে কেউ তাঁদের কাছে অভিযোগ করেননি।
‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ বিজয়ী হওয়ার ধারাবাহিকতা
ফেনীতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তিনটি পৌরসভা নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে তেমন আমেজ ছিল না। পরশুরাম পৌরসভা নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আগেই মেয়র ও ১২ কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর আগে ২০১৬ সালেও এখানে নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলররা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। ওই বছরই অনুষ্ঠিত পরশুরাম উপজেলায় তিনটি ইউনিয়ন পরিষদেই চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
২০১৬ সাল থেকে পরশুরাম পৌরসভা নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই রীতি চলে আসছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বাইরে কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস পান না। প্রতিপক্ষ বিএনপি কিংবা অন্য দল, এমনকি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের ঠেকাতে প্রতিবার নানা কৌশল নেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-১ (ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরাম) আসনে জাসদ নেত্রী শিরীন আখতার, ফেনী-২ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নিজাম উদ্দিন হাজারী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে পরশুরাম উপজেলার ৩টিসহ জেলায় ১০ জন চেয়ারম্যান ও বেশ কিছুসংখ্যক ইউপি সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
২০১৬ সালে ফেনী পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র ও ২৪ জন কাউন্সিলরের মধ্যে একটি ওয়ার্ড ছাড়া ২৩ জন কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সবাই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত নেতা-কর্মী। এ ছাড়া ২০১৬ সালে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত সবাই বিনা ভোটে নির্বাচিত হন। সম্প্রতি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজ আহাম্মদ চৌধুরীর মৃত্যুর পরও একইভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনে খায়রুল বাশার মজুমদার জয়ী হন।
এরপর জেলার ৬টি উপজেলায় ৪৩টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১০টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। এর মধ্যে ফেনীর পরশুরাম উপজেলায় তিনজন, ফুলগাজীতে দুজন, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদরে একজন করে এবং দাগনভূঞা উপজেলায় তিনজন ইউপি চেয়ারম্যান বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও জেলার সোনাগাজী উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জহির উদ্দিন মাহমুদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
মনোনয়ন জমাদানে ভয়ভীতি প্রদর্শন
এবার জেলার তিনটি পৌরসভা নির্বাচনের আগে থেকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভয়ভীতি ও হুমকি-ধমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। পরশুরাম উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল হালিম মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন ফেনী শহরে এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ভয়ভীতি, হুমকি-ধমকির অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। ফলে পরশুরাম পৌরসভায় বিএনপির কোনো প্রার্থী নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকির কারণে বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রার্থী হতেই সাহস পাননি।আলাল উদ্দিন, সদস্যসচিব, জেলা বিএনপি
ফেনী পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী ও জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আলাল উদ্দিন অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকির কারণে বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রার্থী হতেই সাহস পাননি। ফলে ফেনী পৌরসভার ১০টি সাধারণ ও ৫টি সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা ভোটে জিতে যান। তিনি অভিযোগ করেন, মেয়র ও অবশিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের দিন বহিরাগত যুবকেরা সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করেন।
দাগনভূঞা পৌরসভা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র প্রার্থী কাজী সাইফুর রহমানও একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের হুমকি-ধমকির কারণে স্থানীয় বিএনপির কর্মীরা অনেকটা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েন। এতে চারটি সাধারণ ও তিনটি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কাউন্সিলর পদে বিনা ভোটে জিতে যান।