ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন

ভোট নিয়ে আ.লীগের তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা

মনোনয়ন–বাণিজ্যের অভিযোগ। আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন না করার দাবি।

ফাইল ছবি

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ে একধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। কোনোভাবেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। মনোনয়ন–বাণিজ্য নিয়ে দলের সব পর্যায়েই এখন আলোচনা হচ্ছে। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি সংঘাত, হানাহানি ও প্রাণহানির ঘটনা বেড়ে গেছে।

দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচন হলেও এখন আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই ইউনিয়ন পরিষদের ভোট দলীয়ভাবে না করার দাবি জোরালো হচ্ছে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারাতে দলের ভেতরেই একটি অংশ উঠেপড়ে লেগেছে। এমন পরিস্থিতিতে দলের নীতিনির্ধারকেরা বিব্রত। কিন্তু কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে, সে বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে হিমশিম অবস্থায় পড়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ৮৩৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩৪১টিতে নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩১টি ইউনিয়নে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই ছিলেন না দলের প্রার্থীরা। যদিও বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এবার ইউপি নির্বাচনে নেই। এরপরও দ্বিতীয় ধাপের ভোটের এমন ফল দলের নীতিনির্ধারকদের ভাবাচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপের ভোটে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে ৬৪টি ইউপিতে বিএনপির নেতাদের চেয়ারম্যান হওয়ার বিষয়টিও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে অবাক করেছে।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সুষ্ঠু ভোট হলে ইউপি নির্বাচনের পরবর্তী ধাপগুলোতে দলের অনেক প্রার্থীর ভরাডুবির আশঙ্কা আছে। এটা দলের জন্য ‘সতর্কসংকেত’।

আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ভোটের মাঠে সে অর্থে বিরোধী দল না থাকার পরও নৌকার এত প্রার্থীর হেরে যাওয়া উদ্বেগের বিষয়। অনেক জেলা থেকে দাবি উঠছে নৌকা প্রতীক কাউকে না দিয়ে ভোট উন্মুক্ত রাখতে। কয়েকজন সাংসদও এ দাবি তুলেছেন। একাধিক মন্ত্রীরও বিষয়টিতে সায় আছে। এটি দলের নীতিনির্ধারকদের জন্য বিব্রতকর।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়া এবং সারা দেশে নৌকাবিরোধী মনোভাব জোরদার হওয়ার কারণেই ইউপিতে ভোটের ফল খারাপ হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও পাঁচটি বিষয়। ১. মনোনয়ন-বাণিজ্য ২. মন্ত্রী-সাংসদদের পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন। ৩. ব্যাপক দলীয় কোন্দল। ৪. তৃণমূলের মতামতকে সেভাবে গুরুত্ব না দেওয়া এবং ৫. প্রার্থীর জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জরিপ ত্রুটিপূর্ণ।

আগামী শুক্রবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক আছে। সেখানে ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়, সংঘাত-প্রাণহানি, নৌকা প্রতীক না দিয়ে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়াসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

তৃণমূলের তালিকা নামকাওয়াস্তে

করোনা মহামারির মধ্যে মানবিক সহায়তার তালিকায় নাম ওঠাতে গত বছর হতদরিদ্রদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল বগুড়ার শিবগঞ্জের ময়দানহাটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এস এম রুপমের বিরুদ্ধে। গত বছর জুলাই মাসে তাঁকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পরে তিনি আদালতে গেলে মন্ত্রণালয়ের আদেশ স্থগিত করে স্বপদে বহাল হন। এবারও ইউপি নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন পান তিনি। তবে স্থানীয় মানুষ তাঁর অপকর্ম ভুলে যায়নি। নিজ দলের বিদ্রোহীর কাছে তিনি ভোটে হেরে গেছেন।

রুপমকে প্রার্থী করার জন্য কেন্দ্রে এবার সুপারিশ পাঠায়নি শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ। এরপরও তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়। তৃণমূল আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার অন্য ইউনিয়নেও যাঁদের নাম মনোনয়নের জন্য সুপারিশ করেছিল, তাঁদের কাউকে দল নৌকা প্রতীক দেয়নি। ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের ইউপি ভোটে শিবগঞ্জের চারটি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

এ বিষয়ে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ কে এম আসাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তৃণমূল থেকে পাঠানো নাম বাদ দিয়ে কীভাবে প্রার্থী করা হয়েছে, তা তিনি জানেন না। এ জন্যই এমন ফল হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে মাদারীপুরের কালকিনি ও ডাসারের ১৩টি ইউনিয়নের জন্য তৃণমূল থেকে ৭১ জন প্রার্থীর নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়। কিন্তু ডাসার উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি যেসব নাম প্রস্তাব করেছিল, তাঁদের কেউ মনোনয়ন পাননি। কালকিনি উপজেলা কমিটির দেওয়া অধিকাংশ নাম চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়ার সময় বাদ গেছে। ১১ নভেম্বরের ভোটে দুই উপজেলার মাত্র চারটি ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। বাকি নয়টি ইউপির মধ্যে আটটিতে দলের বিদ্রোহী এবং একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছেন।

মাদারীপুর নৌকার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু কালকিনির লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থী মো. মজিবর রহমান মোল্লা মাত্র ৩২৫ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন।

দলের একাধিক সূত্র বলছে, তৃণমূলের তালিকা পাশ কাটিয়ে নিজের পছন্দের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার পেছনে কালকিনির সাংসদ আবদুস সোবহানের ভূমিকা ছিল। তিনি আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডেরও সদস্য। কালকিনির রমজানপুরে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তাঁর ভাই বি এম মিল্টন ইব্রাহিম। তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। ভোটের আগে আগে দেশে আসেন। বিদ্রোহী প্রার্থীকে জোর করে মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে।

কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ তাহমিনা সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ইউপি নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় সাংসদ বাড়াবাড়ি করেছেন। মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে নৌকায় ভোট দেননি। বিদ্রোহীদের জিতিয়েছেন।

মনোনয়ন–বাণিজ্যের অভিযোগ

২০১৬ সাল থেকে দলীয় প্রতীকে ইউপি ভোট হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৭ জনের দলীয় মনোনয়ন বোর্ড আছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য উপজেলা, জেলা থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীর নামের তালিকা তৃণমূল থেকে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠানো হয়। মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে সেই তালিকা উপস্থাপন করা হয়।

এর বাইরে দলীয় সভাপতি তাঁর নিজস্ব সূত্র ও গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা করেন। এতে প্রার্থীদের জনপ্রিয়তার ক্রম সাজানো থাকে।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি পর্বেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের টাকা খরচ করতে হয়। প্রথমে তৃণমূলের তালিকায় নাম ওঠানো এবং জেলায় তা অটুট রাখার জন্য টাকা খরচ করতে হয়। কোন্দলের কারণে তৃণমূলের তালিকায় নাম না থাকলে পাল্টা কমিটির মাধ্যমে তালিকা পাঠানোর নজিরও আছে। এ ক্ষেত্রেও টাকা খরচ হয়। এর বাইরে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে নিজের জনপ্রিয়তা দেখাতেও টাকা খরচ করেন কোনো কোনো প্রার্থী। মনোনয়ন বোর্ডের এক বা একাধিক সদস্যকেও নানাভাবে খুশি রাখতে হয়।

দলীয় সূত্র বলছে, মনোনয়ন পেতে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীকে কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। একইভাবে মনোনয়নবঞ্চিতদেরও টাকা খরচ হয়।

তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে (২৮ নভেম্বর ভোট) নরসিংদী জেলার একজন বিদ্রোহী ইউপি প্রার্থী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, মনোনয়ন পাবেন—এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন না পাওয়ায় বিদ্রোহী হয়েছেন। যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন, তিনিও টাকা খরচ করেই পেয়েছেন। ফলে লড়াই হবে টাকায় টাকায়।

উত্তরবঙ্গের প্রার্থীদের চেয়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলের প্রার্থীদের মনোনয়ন পেতে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে এমন আলোচনাও দলে আছে।

মনোনয়ন–বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা সত্য। কিছু তো হয়ই। সবাই তো একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা না।’

বিদ্রোহী আরও বাড়ছে

দ্বিতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ছিলেন ৮৯৭ জন। তৃতীয় ধাপে তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬৯ জন। প্রথম দুই ধাপে ভোটের সংঘর্ষে প্রাণ গেছে ৩২ জনের। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রাশিদুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল সারা দেশে বিদ্রোহী প্রার্থী চিহ্নিত করতে কাজ করছে। তাঁদের অনুমান হচ্ছে, পরবর্তী ধাপগুলোতে বিদ্রোহী প্রার্থী আরও বাড়বে।

দলীয় সূত্র বলছে, বিদ্রোহীদের পেছনে দলের স্থানীয় নেতাদের একটা অংশ আছেন। কোথাও কোথাও আছেন মন্ত্রী-সাংসদ। আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, বিদ্রোহীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু একজন বিদ্রোহীর সঙ্গে পাঁচ–দশ হাজার মানুষ আছেন। সে ক্ষেত্রেও তাঁদেরও কি দল বাদ দেবে?

নৌকা প্রতীক না দেওয়ার দাবি জোরালো

প্রথম ধাপের ভোটে সব ইউনিয়নেই প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে মাদারীপুরে সাতটি ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী না দিয়ে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও ৮৮টি ইউনিয়নে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে শরীয়তপুরে ৫৫, মাদারীপুরে ২৬ এবং গোপালগঞ্জের ৭টি ইউনিয়ন রয়েছে।

এসব ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী না দেওয়ার জন্য শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের সাতজন সাংসদ দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানান। পরে নোয়াখালী, নরসিংদী, নাটোর থেকেও সাংসদেরা তাঁদের নিজ নিজ জেলায় দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন না দিতে অনুরোধ করেছেন।

নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ আবদুল কুদ্দুস চিঠি দেওয়ার কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের লোক নিজ দলের লোককে হত্যা করছেন। মামলা হচ্ছে, কারাগারে যাচ্ছেন। নির্বাচনে হারজিতের শোধ নিচ্ছেন নিজ দলের লোকজনের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ভাঙচুর করে। ফলে দল বিপদের মুখে। এখনই দলীয় প্রতীকে ভোট বন্ধ করা দরকার।