যশোর শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদের তীরের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযান থমকে গেছে। মাস দেড়েক আগে শহরের দড়াটানা সেতুর পশ্চিম পাশের ৮৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হলেও পূর্ব পাশের দেড় শতাধিক অবৈধ স্থাপনা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।
সেতুর পূর্ব পাশে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বহুতল ভবনে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যে কারণে শহরবাসীর মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ভৈরব উচ্ছেদ অভিযান থামল কেন?
এদিকে অবৈধ দখলদার থাকায় ভৈরব নদ খনন প্রকল্পের শহরাংশের চার কিলোমিটার খননকাজের জন্য ঠিকাদার পাচ্ছে না বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ইতিমধ্যে পাঁচ দফায় দরপত্র আহ্বান করেও কোনো ঠিকাদার মেলেনি। ষষ্ঠ দফায় ১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করে এ চার কিলোমিটারের জন্য আবারও দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ২৬ মে দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন।
একসময় ভৈবর নদ ছিল যশোর শহরের প্রাণ। দখল ও দূষণে প্রমত্তা ভৈরব এখন মরা খাল। শহরবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে যশোরে এসে ভৈরব নদ খননের প্রতিশ্রুতি দেন। ওই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২৭২ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে পাঁচ বছর মেয়াদি ‘ভৈরব রিভার বেসিন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প’ শুরু হয়।
পাউবো, যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ৯২ কিলোমিটার খননকাজ হবে। ইতিমধ্যে নদের উজান ও ভাটির ৭০ কিলোমিটারের বেশি খননকাজ চলমান রয়েছে। যশোর শহরাংশের চার কিলোমিটার এলাকায় খননকাজ নিয়ে বিপাকে পড়েছে পাউবো। পঞ্চমবারের মতো ১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয় ধরে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র জমাদানের শেষ দিন ছিল ৭ মে। কিন্তু কোনো ঠিকাদার দরপত্র জমা দেননি। পুনরায় ষষ্ঠ দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
দরপত্রে ঠিকাদারেরা অংশ নিচ্ছেন না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে পাউবো যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই চার কিলোমিটারে খননকাজ চালানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অংশে নদের মাটি রাখার জায়গা কম। বিশেষ করে দড়াটানা সেতু থেকে কাঠেরপুল সেতু পর্যন্ত পৌনে এক কিলোমিটারের দুই পাশে মাটি রাখার জায়গা নেই। এখানে কাদামাটি ও বর্জ্য বেশি। যে কারণে ঠিকাদারেরা আগ্রহী হচ্ছেন না।’
সরেজমিনে দেখা যায়, দড়াটানা সেতুর পূর্ব পাশের হাজী মুহম্মদ মুহসীন ও জেল সড়কের পাশ দিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়িসহ ১৫০টিরও বেশি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এ ছাড়া নদের প্লাবন ভূমিতে রয়েছে আরও কয়েকটি বহুতল ভবন। এসব ভবনে নামী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।
জানতে চাইলে ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘১৯২৬ সালের ভূমি জরিপ (এসএ) রেকর্ডের সঙ্গে নদীর প্লাবন ভূমি আইন অনেকটা সাংঘর্ষিক। প্লাবন ভূমি আইন বাস্তবায়ন করতে গেলেই দখলদারেরা ১৯২৬ সালের রেকর্ড অনুযায়ী আদালতে মামলা করার সুযোগ পাবে। এ জন্য নদীর সীমানা নির্ধারণের সংজ্ঞা রাজনৈতিকভাবে সংসদে আগে পাস হতে হবে। এরপর উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হবে। তা না হলে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা ফন্দি-ফিকির করে উচ্ছেদ আটকে দিতে পারেন। এতে খনন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে। ২০২১ সালের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু এখনো অভিযান শেষ হলো না। তাহলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তাবায়ন হবে কেমনে? দ্রুত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে নদে জোয়ার-ভাটা ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আবদুল আওয়াল বলেন, ‘ভৈরব নদের তীরের সব অবৈধ স্থাপনা আমরা উচ্ছেদ করবই। কিন্তু আমার জনবলসংকটে করতে পারছি না। যশোর প্রশাসনের ১৯ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের (সহকারী কমিশনার) মধ্যে রয়েছেন ৬ জন। ১৩ জন বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণে রয়েছেন। যৌথ জরিপের জন্য একজন সার্ভেয়ার নিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁকেও গত মঙ্গলবার বদলি করা হয়েছে। জনবলসংকট দূর হলেই আবার উচ্ছেদ অভিযান শুরু করব।’