দ্বীপজেলা ভোলায় রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কোম্পানি বাপেক্সের আবিষ্কৃত নতুন গ্যাসক্ষেত্র থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে। আজ শনিবার বেলা সোয়া একটায় এই উৎপাদন শুরু হয় বলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশাদ ইসলাম প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। গত সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই ক্ষেত্র আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করা হয়।
ভোলার উত্তর প্রান্তে ভেদুরিয়া নামক স্থানে নতুন ক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হয়েছে বাপেক্সেরই ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের (থ্রি-ডি সাইসমিক সার্ভে) তথ্যের ভিত্তিতে। এটি দেশে আবিষ্কৃত ২৭তম গ্যাসক্ষেত্র। ক্ষেত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভোলা নর্থ’। ভোলায় বিদ্যমান শাহবাজপুর ক্ষেত্র থেকে এই ক্ষেত্রের দূরত্ব প্রায় ৩২ কিলোমিটার। এখন ভোলার দুটি ক্ষেত্র মিলে মোট গ্যাসের মজুদ দুই টিসিএফের (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) কাছাকাছি হতে পারে বলে বাপেক্সের বিষেশজ্ঞ কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।
ভেদুরিয়া থেকে বাপেক্সের কর্মকর্তা মেহেরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ক্ষেত্রটিতে একটি কূপ খনন করা হয়েছে। এটি থেকে গতকাল যে হারে গ্যাসের প্রবাহ পাওয়া গেছে, এতে ধারণা করা যায় যে এই কূপ থেকে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কোটি (২০-২৫ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। ক্ষেত্রটিতে এরপর আরও কূপ খনন করার পরিকল্পনা বাপেক্সের রয়েছে।
এর আগে গত ১ নভেম্বর ভোলার শহবাজপুর ক্ষেত্রের সম্প্রসারিত অংশে খনন করা একটি নতুন কূপের দুটি স্তর থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছিল। বোরহানউদ্দিন উপজেলার শাহবাজপুরে বিদ্যমান ক্ষেত্রটি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে একই থানার টাবগী ইউপির মুলাইপত্তন গ্রামে এই কূপও খনন করা হয়েছে বাপেক্সের ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে।
ভোলায় এই গ্যাসক্ষেত্রের আবিস্কার জ্বালানি সম্পদ সম্পর্কে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, বেঙ্গল বেসিনভুক্ত ভোলায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্যাস পাওয়ায় দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তরাঞ্চলে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে।
দেশের অন্য সব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে সুরমা বেসিনভুক্ত সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এই বেসিনের ভূকাঠামোর ভূতাত্ত্বিক নাম ‘অ্যান্টি ক্লেইন স্ট্রাকচার’। অন্যদিকে, তাত্ত্বিক ভূতত্ত্ব অনুযায়ী বেঙ্গল বেসিনের ভিন্ন বৈশিষ্ঠ্যের ভূকাঠামোর নাম ‘স্টেটিগ্রাফিক স্ট্রাকচার’। এ ধরনের কাঠামোয় তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে প্রকৃতি যে কখনো কখনো এই তত্ত্ব নাকচ করে দেয়, সে ঘটনা বিরল নয়।
ভোলা ছাড়া বেঙ্গল বেসিন ও স্টেটিগ্রাফিক স্ট্রাকচারে এখন পর্যন্ত গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে শুধু পাবনার মোবারকপুরে। তবে ভোলায় বড় ধরনের মজুত আবিষ্কৃত হওয়ায় এবং ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপে আরও গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনা আছে বলে ধারণা করায় দেশের অন্যান্য এলাকায়ও তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাপেক্সের সাবেক এমডি, ভূতত্ত্ববিদ এম এ বাকি প্রথম আলোকে বলেন, ভোলায় বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার বেঙ্গল বেসিনে আরও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে আরও জরিপ-অনুসন্ধান চালানো এবং কূপ খনন করা দরকার। নিবিড় অনুসন্ধান গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে।
বাপেক্সের সূত্র জানায়, ১৯৮৬ সালে ভোলায় ২৬৬ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের মাধ্যমে শহাবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রটির সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু ভোলায় আরও গ্যাস আছে বলে সংশ্লিষ্ট ভূতত্ত্ববিদেরা ধারণা করতেন। আমেরিকান কোম্পানি ইউনোক্যাল ২০০৩-০৪ সালে চালানো এক জরিপের ভিত্তিতে ভোলায় অন্তত তিন টিসিএফ গ্যাস থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছিল। তাঁরা ভোলার গ্যাস তুলে খুলনা পর্যন্ত সরবরাহ করার ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে আলোচনায়ও অনেক দূর এগিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার পরিবর্তনের কারণে তখন আর তা হয়নি।
এরপর বাপেক্স ২০১৬ সালে পুরো দ্বীপের ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ চালায়। তাতে যে চিত্র পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতেই মুলাইপত্তন ও ভেদুরিয়ায় কূপ খনন করা হয়।