>
গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ২ লাখ ৩০ হাজার ৪৩৮।
আওয়ামী লীগের ১০ বছরেও পূর্ণাঙ্গ তালিকা হলো না।
আওয়ামী লীগ সরকার টানা প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে পারেনি। উল্টো ২৫ হাজার ৫০০ গেজেটভুক্ত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রেখেই বর্তমান মেয়াদ শেষ করতে যাচ্ছে সরকার।এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও পাঁচ সচিব ও বিভিন্ন সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীসহ প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন, বিএনপির আমলে প্রায় ২২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছে। আর আওয়ামী লীগ আমলে (২০০৮ থেকে ২০১৪) গেজেটভুক্ত হয়েছে সাড়ে ১১ হাজার, যার প্রায় সবই ভুয়া। এই ২২ হাজার ও সাড়ে ১১ হাজার মিলে হয় সাড়ে ৩৩ হাজার। এই ভুয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, তাদের চিহ্নিতই করতে পারেনি সরকার।
তবে মন্ত্রী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, তাঁর আমলে আট হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল করা হয়েছে। এই হিসাব সত্য হলে এখনো ২৫ হাজার ৫০০ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। যদিও দুই সপ্তাহ অনেক চেষ্টা করেও আট হাজার মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিলের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গেজেট শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, চার হাজারের মতো গেজেট বাতিল করা হলেও বেশির ভাগ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আদালতের আদেশ এনেছেন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, ফৌজদারি আইনের ৪১৬ ধারা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিলে তা অপরাধ। এ ছাড়া মিথ্যা তথ্য দেওয়ার জন্য তিন বছর জেল এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেখিয়ে ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধা নিলে সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ঠিক, আমরা সব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করতে পারিনি বা তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারিনি। তবে আমরা কোনো অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানাইনি।’ তিনি স্বীকার করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে না পারা আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা। কিন্তু বিভিন্ন জেলা কমিটি থেকে আসা তালিকায় ভুয়াদের উপস্থিতি বেশি বলে আর এগোনো যায়নি।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, নতুন সরকার এলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন হয়, বেড়ে যায় সংখ্যাও। ৪৭ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড ১১ বার পাল্টেছে। সর্বশেষ এ বছরের ১৬ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বয়সসীমা ছয় মাস কমানো হয়। অর্থাৎ সাড়ে ১২ বছরের গেজেটভুক্ত সবাই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেন।
সরকারের পাঁচ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুয়া সনদ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয় ২০১৪ সালে। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) তৎকালীন সচিব এ কে এম আমির হোসেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী এবং একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবুল কাসেম তালুকদারের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। বাতিল করা হয় সাবেক সচিব এবং প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তৎকালীন বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের সনদও। সনদ ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পর তাঁদের স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ছিল। তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে আইনি ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছিল দুদক। কিন্তু গত চার বছরে কোনো মামলা হয়নি। এ ছাড়া চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করেননি, অথচ পরে সনদ নিয়েছেন, এমন অভিযোগ পাওয়া যায় এক সচিবসহ ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের ১০ বছরে প্রকৃত ও নির্ভুল তালিকা করাকে কেন্দ্র করে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত বছর জানুয়ারি মাসে ঢাকঢোল পিটিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার। নতুন করে প্রায় দেড় লাখ আবেদন আসে। সরকার চেয়েছিল পাঁচ হাজার অন্তর্ভুক্ত করতে। কিন্তু যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় শেষ পর্যন্ত নতুন তালিকা প্রকাশ স্থগিত করতে বাধ্য হয় সরকার। কয়েক মাসের এই কাজের জন্য সব মিলিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই তালিকা চূড়ান্ত করতে না পারাটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এটা সরকারের ব্যর্থতাও বলা যায়।
সরকারের হিসাবে দেশে এখন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৩০ হাজার ৪৩৮। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাদত হুসাইনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গেজেটভুক্ত করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে অভিযোগ করে, বিএনপির আমলে ৭০ হাজারের বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এরপর সরকার নতুন করে আরও সাড়ে ১১ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে গেজেটভুক্ত করে। তখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম।