ভুয়া আইডি খুলে জুলহাজদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন এক আসামি

জুলহাজ মান্নান ও খন্দকার মাহবুব রাব্বী তন্ময়।
ফাইল ছবি

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. জুবায়ের ঢুকে পড়েছিলেন জুলহাজ মান্নানদের সঙ্গে। ফেক আইডি খুলে তিনি তাঁদের সঙ্গে চ্যাট করেছেন, অংশ নিয়েছেন তাঁদের সমাবেশ–উৎসব ও অনুষ্ঠানে। তারপর তথ্য পাঠিয়ে দিতেন আনসার আল ইসলামের কাছে।

ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও অভিনেতা খন্দকার মাহবুব রাব্বী তন্ময় হত্যাকাণ্ডের আসামি মো. জুবায়ের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা জানান। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরিকল্পিতভাবে ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানে বাসায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় জুলহাজ ও মাহবুবকে।

পাঁচ বছরের বেশি সময় পর ৩১ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে কলাবাগানের আলোচিত এই জোড়া খুনের রায় ঘোষণার কথা রয়েছে। মামলাটি তদন্ত করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।

এই মামলায় যাঁদের আসামি করা হয়েছে, তাঁরা হলেন সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক, আকরাম হোসেন, সাব্বিরুল হক চৌধুরী, মো. জুনাইদ আহমেদ, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, মো আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস, জুবায়ের ওরফে মো. শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের ও আসাদুল্লাহ ওরফে ফয়জুল ওরফে ফয়সাল। প্রথম চার আসামি এখনো পলাতক।

আসামি মো. জুবায়ের।

আসামিপক্ষের উকিল এম নজরুল ইসলাম ও খায়রুল বাশার লিটন বলেছেন, তাঁরা আশাবাদী তাঁদের মক্কেলরা খালাস পাবেন। এম নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সত্য। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হিসেবে যাঁদের হাজির করেছে, তাঁরা আসামিদের শনাক্ত করতে পারেননি।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মো. গোলাম ছারোয়ার খান প্রথম আলোকে বলেন, এই মামলায় আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান ও সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আটজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ। আসামিদের চারজন পলাতক। বাকি চারজনই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা দায় স্বীকার করে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি এড়ানোর সুযোগ নেই।

জুবায়ের যা বলেছেন

মো. জুবায়ের চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন। আনসার আল ইসলামের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ২০১৩ সালে। সংগঠনে তাঁর আরও বেশ কটি নাম রয়েছে। অভিযোগপত্রে পুলিশ বলেছে, তিনি দলের ভেতর কখনো শেখ আবদুল্লাহ, জায়েদ, জাবেদ বা আবু ওমায়ের। তাঁর স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের জাকির হোসেন রোডে।

শুরুর দিকে জুবায়ের পেনড্রাইভ থেকে বিভিন্ন নথিপত্র, ছবি ও ভিডিও ডাউনলোড করে ২০০–২৫০ সিডিতে কপি করতেন। এর বিনিময়ে সংগঠন থেকে তিন মাসে তিনি পান ৩৩ হাজার টাকা। সৈয়দ জিয়াউল হকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ২০১৪ সালে। ওই বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসের শেষে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসতেন। সংগঠনের কেউ একজন তাঁর হাতে একটি ব্যাগ ধরিয়ে দিতেন, তিনি সেটা পৌঁছে দিতেন জিয়ার কাছে। এর মধ্যেই দক্ষিণখানের একটা আস্তানায় তাঁর প্রশিক্ষণ হয় এবং দল তাঁকে গোয়েন্দা শাখার সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে।

জুবায়ের পাকাপাকিভাবে সৈয়দ জিয়াউল হকের নির্দেশে ঢাকায় আসেন ২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি। এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায় অন্য জঙ্গিদের সঙ্গে আস্তানা গাড়েন তাঁরা। ওই আস্তানায় যাঁদের যাতায়াত ছিল, তাঁদের কেউ কেউ জুলহাজ ও মাহবুব হত্যাকাণ্ডসহ একাধিক মামলায় আসামি। ওই বাসাতে বসেই তাঁরা কাদের কাদের খুন করা হবে, তার তালিকা তৈরি করেন। চার ধরনের লোককে খুনের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। এর একটি ছিল সমকামী।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জুবায়ের বলেন, ‘আমাকে সমকামীদের ব্যাপারে ব্যাপক খোঁজ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আমি সমকামীদের ব্যাপারে ফেসবুক ও অনলাইনে খোঁজখবর নিতে থাকি। সে সময় প্রধান দুই সমকামী সংগঠন রূপবান ও বয়েজ অব বাংলাদেশ আমার টার্গেট।’

আসামি জুবায়ের বলেন, ‘টার্গেট’দের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তিনি জায়েদ বিন ইফরান নামে একটি ফেসবুক আইডি খোলেন। এই আইডি থেকে তিনি রূপবানের সদস্যদের ফেসবুকের তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন। একই তথ্য পাওয়া গেছে আরেক আসামি মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মনের জবানবন্দিতেও।

সমকামীদের অধিকারবিষয়ক সাময়িকী ‘রূপবান’।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সমকামী তরুণদের সংগঠন হলো বয়েজ অব বাংলাদেশ। আর ‘রূপবান’ ছিল তাদের অধিকারবিষয়ক একটি সাময়িকী। খন্দকার মাহবুব রাব্বী মূলত এই সাময়িকীর জন্য কাজ করতেন, অর্থায়ন করতেন জুলহাজ মান্নান। নাম না প্রকাশ করার শর্তে এই দুজনেরই ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেন, জুলহাজরা চাইছিলেন সমকামিতা ইস্যুটিকে ধামাচাপা দেওয়ার যে প্রবণতা, সেটা দূর হোক। তাঁরা প্রকাশ্যে আসতে চাইছিলেন। র‍্যালি করছিলেন, এমনকি বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো সমাবেশ ও অনুষ্ঠানও করছিলেন। ২০১৪ ও ’১৫ সালে মোটামুটি নির্বিঘ্নেই তাঁরা পয়লা বৈশাখে মিছিলও করেছিলেন। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হতে শুরু করে। ওই বছর পয়লা বৈশাখের র‍্যালির আগে তাঁদের পুলিশি বাধার মুখেও পড়তে হয়। তারপরও অবশ্য তাঁরা একটা মিছিল করেছিলেন।

জুবায়ের ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এমন একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তিনি ওই দিন বেলা দুইটায় শাহবাগ মোড়ে সংগঠনের সদস্য হাসানের সঙ্গে দেখা করেন। হাসান সেজেছিলেন বাদাম বিক্রেতা। তারপর দুজন মিলে রমনা পার্কে যান ও সমকামীদের মিলনমেলায় অংশগ্রহণ করেন। জুবায়ের তাঁদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন আর হাসান দূর থেকে তাঁকে অনুসরণ করছিলেন। ওই বছরের জানুয়ারিতেই সৈয়দ জিয়াউল হক ‘রূপবান’ সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছিলেন।

জিয়াই পরে তাঁকে জানান, ১৪ এপ্রিল সমকামীদের একটা মিছিল হবে। তিনি যেন দ্রুত চট্টগ্রাম থেকে চলে আসেন। দল থেকে তাঁকে ওই মিছিলে যোগ দিতে বলা হয়। তিনি ছাড়াও ওই মিছিলে আরও দুজনকে যুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাঁদের একজন ছিলেন তারেক। তারেককে অবশ্য আরও একটি দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁকে বলা হয়েছিল খন্দকার মাহবুব রাব্বীর বাসা খুঁজে বের করতে। তারেক ওই বাসা আর খুঁজে পাননি। তিনি জিয়াকে বলেন, মাহবুবের বাসা খুঁজে না পেলেও তিনি জুলহাজের বাসা খুঁজে পেয়েছেন। এবার তাঁদের জুলহাজের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে বলা হয়।

হত্যাকাণ্ডের আগে টানা পাঁচ থেকে ছয় দিন জঙ্গিরা জুলহাজের গতিবিধির ওপর নজর রাখেন। তাঁরা জানতে পারেন, জুলহাজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বাসা থেকে বের হন, বিকেল পাঁচটায় ফেরেন। সব তথ্য তাঁরা জানান এই মামলার আরেক আসামি সায়মনকে। পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের আস্তানায় এক হন আনসার আল ইসলামের একদল সদস্য। তাঁরা জিয়াকে জানান, জুলহাজ মান্নানের বাসার আশপাশে দোকানপাট আছে। তাঁকে দিনের বেলা ‘কতল’ করে নিরাপদে পালিয়ে আসা যাবে না। বাসায় ঢুকে হত্যা করতে হবে।

জিয়া সিদ্ধান্ত দেন, কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী সেজে আনসার আল ইসলামের লোকজন ঢুকবেন জুলহাজ মান্নানের বাসায়। তিনটি ভুয়া আইডি ও ভাউচার বানানোর নির্দেশ দেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র মোজাম্মেল হুসেইন ওরফে সায়মনকে। হত্যাকাণ্ডের দিন ঠিক হয় ২৫ এপ্রিল।

হত্যাকাণ্ডের দিন কার কী ভূমিকা ছিল

জুবায়ের বলেন, ঘটনার দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মোজাম্মেল হুসেইন ওরফে সায়মন, আসাদুল্লাহ ওরফে ফয়জুল, সাব্বিরুল হক চৌধুরী ওরফে সাদমান ও মো. জুনায়েদ ওরফে হাকতাব এই তিনজনকে নিয়ে আসেন এবং জুলহাস মান্নানের বাসা ও এর আশপাশে রেকি করে চলে যান। মোজাম্মেল তাঁদের দেখলেও ওই সময় কোনো ইঙ্গিত করেননি। যদিও জুবায়ের, আকরাম ওরফে আবির ওরফে আদনান ও হাসান সকাল নয়টা থেকেই ওখানে অবস্থান করছিলেন। দুপুরে হাসান চলে যান। কিন্তু থেকে যান জুবায়ের ও আকরাম। বিকেল পাঁচটার দিকে জুলহাস মান্নান হেঁটে বাসায় ফেরেন। আনুমানিক ১৫ মিনিট পর রিকশায় জুলহাজদের বাসায় পৌঁছান মাহবুব রাব্বী।

বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আনসার আল ইসলামের অপারেশন শাখার পাঁচ সদস্য জুলহাজ মান্নানের বাসার ফটকের সামনে অবস্থান নেন। আকরাম ওরফে আবির ওরফে আদনান অপারেশন শাখার সদস্যদের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলেন। তাঁরা মাহবুবের চেহারা ও গড়নের বর্ণনা দেন এবং তাঁকেও খুনের নির্দেশ দেন।

পাঁচজনের মধ্যে তিনজনের গায়ে কুরিয়ার সার্ভিসের ইউনিফর্ম ছিল, গলায় ছিল ভুয়া পরিচয়পত্র।

উল্লেখ্য, অভিযোগপত্রে পুলিশ পরিদর্শক মুহম্মদ মনিরুল ইসলাম লিখেছেন, মোজাম্মেল হুসেইনের ল্যাপটপ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের ল্যাবরেটরিতে ফরেনসিক পরীক্ষা করায় পুলিশ। তাঁর কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে ই–কুরিয়ার ডটকম বিডির ম্যানেজার অপারেশনস পদের মাহবুবুল আলম, সাইফুল ইসলাম ও আবদুর রাজ্জাকের নামের তিনটি আইডি কার্ড আছে।

আসাদুল্লাহ ওরফে ফয়জুলের গলায় যে আইডি কার্ড ছিল, তাতে লেখা ছিল মাহবুবুল আলম আর সাদ্দামের আইডি কার্ডে নাম লেখা হয় সাইফুল। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় তিনজন জুলহাজদের বাসায় পার্সেল নিয়ে ওঠেন। জুবায়ের ও আকরাম কিছুটা দূরে অপেক্ষা করছিলেন। বাড়ির ফটকে দুজন নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। তাঁদের একজন ভুয়া কুরিয়ার সার্ভিসকর্মীর সঙ্গে ওপরে ওঠেন। মিনিট পাঁচেক পরই তাঁরা বাসার ভেতর থেকে চিৎকার করতে থাকেন। চিৎকারের শব্দ শুনে তাঁরাও মূল ফটকের পাশের পকেট গেটে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢোকেন ও তাঁদের সঙ্গে থাকা পিস্তল থেকে গুলি ছোড়েন। গুলির শব্দের এক–দুই মিনিট পর অপরারেশন শাখার পাঁচজন হাতে চাপাতি নিয়ে দৌড়ে গেট থেকে বের হয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান।

জোড়া খুনের পর হত্যাকারীরা কী করেছেন, তার বিবরণ আছে আসাদুল্লাহর জবানবন্দিতে। আসাদুল্লাহ বলেছেন, ওই বাসা থেকে ৫০ গজ দূরে মোড় পার হওয়ার সময় জনগণ তাঁদের পিছু নেন। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে ‘আকিল’ ফাঁকা গুলি ছোড়ে। কিছুদূর যাওয়ার পর জুনায়েদকে পুলিশ জাপটে ধরে। আকিল তখন পুলিশকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জুনায়েদকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। তারপর তাঁরা বাসে করে আসাদ গেটে এসে নামেন। তিনি ও জুনায়েদ গাজীপুরের চৌরাস্তার বাসায় চলে যান। অন্য তিনজন ‘আকিলে’র বোর্ডবাজারের বাসায় আশ্রয় নেন।