>• খুলনার সাংবাদিক হেদায়েত জামিনে মুক্তি পেয়েছেন
• ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে হেদায়েত
• হেদায়েত গ্রেপ্তারের পর জোর আলোচনা—ভুলটা কার
খুলনার সাংবাদিক হেদায়েত হোসেন মোল্লা গতকাল বৃহস্পতিবার ১১ দিনের অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, ভুলটা আসলে কার। ৩০ ডিসেম্বর রাতে ভোটের ফল ঘোষণার সময় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থিত থাকা সাংবাদিকেরা বলছেন, ওই ভুলের সূত্রপাত রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেনের ঘোষণা থেকে। সেদিনকার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, জেলা প্রশাসক নিজের মুখে বলছেন, নৌকার প্রার্থী ২ লাখ ৫৩ হাজার ও ধানের শীষের প্রার্থী ২৮ হাজার ১৭০ ভোট পেয়েছেন। ওই দুই ভোটসংখ্যার যোগফল খুলনা-১ আসনের মোট ভোটারের চেয়ে ২২ হাজার বেশি। ঘণ্টাখানেকের পরে জেলা প্রশাসক চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে আবারও ওই আসনের ফল ঘোষণা করেন। তখন বলা হয়, ১ লাখ ৭২ হাজার ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের পঞ্চানন বিশ্বাস।
খুলনা-১ আসনের মোট ভোটারের চেয়ে ২২ হাজার ভোট বেশি পড়েছে বলে সংবাদ প্রকাশ করে প্রশাসনের কোপে পড়েন ঢাকা ট্রিবিউন ও মানবজমিন–এর খুলনা প্রতিনিধি যথাক্রমে হেদায়েত হোসেন মোল্লা ও রাশিদুল ইসলাম। তাঁদের বিরুদ্ধে সোমবার রাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা দেবাশীষ চৌধুরী। মামলায় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়। সেই মামলায় মঙ্গলবার দুপুরে গ্রেপ্তার করা হয় হেদায়েত হোসেনকে, তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ছবিটি এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বুধবার পুলিশ তাঁকে আদালতে নিয়ে তিন দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা এবং সাংবাদিকদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদের মুখে গতকাল সন্ধ্যায় জামিনে মুক্তি পান হেদায়েত। তাঁকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন জেলা দায়রা জজ আদালত।
হেদায়েত গ্রেপ্তারের পর থেকেই জোর আলোচনা—ভুলটা কার। খুলনা ও ঢাকার অন্তত পাঁচজন সংবাদকর্মী বলছেন, জেলা প্রশাসকই প্রথম দফায় ভুল ঘোষণা দিয়েছেন। সাংবাদিকদেরই একজন মোট ভোটারের চেয়ে ঘোষিত ফলে ভোটার সংখ্যা বেশি বলে জেলা প্রশাসকের নজরে আনেন। কিন্তু এরপরেও জেলা প্রশাসক ওই ফলাফলটা বাতিল বা বিষয়টি বিবেচনাধীন—এ ধরনের কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই ঘণ্টাখানেক পরে আবারও একটি ফলাফল ঘোষণা করেন। এর মধ্যেই কোনো কোনো সাংবাদিক সেই ফলাফল তাঁদের প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেন।
সাংবাদিকদের তোলা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, জেলা প্রশাসক বলছেন, ‘...ধানের শীষ ২৮ হাজার ১৭০ ভোট, নৌকা ২ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬৯।’ তখনই একাধিক সংবাদকর্মী দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এর আগে যখন বলেছিলেন, তখন ধানের শীষের ভোট ২৯ হাজার বলে ঘোষণা এসেছিল। ওই কথা শুনে জেলা প্রশাসক জিবে কামড় দিয়ে হাতের কাগজটি ভালোভাবে দেখছিলেন। ওই কাগজ থেকে তিনি ভোটের ফল পড়ছিলেন। এর ঘণ্টাখানেক পরে জেলা প্রশাসককে বলতে শোনা যায়, ‘ভোটকেন্দ্র ১০৭, আমরা ফলাফলও পেয়েছি ১০৭। বিজয়ী ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৯ ভোটে, পঞ্চানন বিশ্বাস আর ওনার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষ ২৮ হাজার ৪৩৭ ভোট।’
এ বিষয়ে খুলনার জেলা প্রশাসক ও নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হেলাল হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওখানে অনেকগুলো আসনের ফলাফল আসছিল, আমি মনে হয় তখন অন্য কোনো আসনের ফল ঘোষণা করছিলাম। ওটা খুলনা-১–এর নয়। শুধুমাত্র দাকোপ উপজেলার ফল ঘোষণার সময় মনে হয় কয়েক শ ভোট এদিক-ওদিক হয়েছিল, ২৮ হাজার সামথিং আর ২৯ হাজার। এর বাইরে এ রকম হওয়ার কথা নয়।’
একটি ভিডিওতে তিনি ২ লাখ ৫৩ হাজার নৌকার ভোট ঘোষণা করছেন উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হলে হেলাল হোসেন বলেন, ‘আসলে তখন কী বলেছি, সেটা তো এখন আর মনে নেই। ভিডিওটাও হাতের কাছে নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমার স্বাক্ষর করা ফলাফলটা হলো আসল। যতক্ষণ না পর্যন্ত সেটা পাওয়া যায়, ততক্ষণ এভাবে বলা যাবে না।’
তাহলে একেবারে স্বাক্ষর করা ফলাফল হাতে হাতে দিলেই হয়, এ রকম মুখে বলে ফল ঘোষণার প্রয়োজনটা কী জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ‘দায়িত্বশীল সাংবাদিক হিসেবে তাঁদের উচিত ছিল বিষয়গুলো যাচাই করে নেওয়া। আমি যখন খাদ্যমন্ত্রীর পিএস ছিলাম, তখনো সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করেছি। তখন ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকেরা কোনো বিষয় অস্পষ্ট থাকলে সে বিষয়ে জেনে নিয়ে তারপর পরিবেশন করতেন।’
৩০ ডিসেম্বর রাতে খুলনার রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে ছিলেন একাত্তর টিভির বিশেষ প্রতিনিধি পারভেজ নাদির রেজা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা যখন ঘোষণা দিলেন, নৌকা ২ লাখ ৫৩ হাজার আর ধানের শীষ ২৮ হাজার, তখনই কয়েকজন সাংবাদিক তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘তাতে তো মোট ভোটারের চেয়ে ভোটসংখ্যা বেশি হয়।’ অসামঞ্জস্যটি ধরিয়ে দেওয়ার পর ‘তাই নাকি তাই নাকি’ বলে তখন রিটার্নিং কর্মকর্তা কাউকে ফোন করেন। মুখের সামনের মাইক্রোফোন চালু রেখেই তিনি মুঠোফোনে জেলা প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাকে ইংরেজিতে বকাবকি করেন। কিন্তু তাঁর ঘোষিত ফলাফলটি সাংবাদিকেরা গ্রহণ করবেন কি না, সে বিষয়ে তিনি কিছুই বলেননি, কোনো ব্যাখ্যাও দেননি। ঘণ্টাখানেক পর তিনি চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতি
ইউএনবি জানায়, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কানাডা শাখা গত রোববার অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের ওপর হওয়া হামলার ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বুধবার অ্যামনেস্টির ওয়েবসাইটে এ আহ্বান জানিয়ে বাছবিচারহীনভাবে গ্রেপ্তার করা সাংবাদিক ও নেতা–কর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ারও আহ্বান জানায়।
সিপিজের বিবৃতি
সাংবাদিক হেদায়েত হোসেন মোল্লাকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) গত বুধবার বলেছে, সরকারের উচিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় তার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করা এবং গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার থেকে বিরত থাকা।