নির্ধারিত দিনে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান গেলেন সাভার থানায়। সভাকক্ষটি জনাকীর্ণ। কর্মকর্তারা জানালেন, সাভারের বেদেপাড়ায় ১৭ জন সরদার আছেন, তাঁরা সবাই এসেছেন।
পুলিশ সুপার (এসপি) সবাইকে বসতে বললেন। তাঁরা বসছেন না। কয়েকজন বলে উঠলেন, ‘বাবু, আমরা কি কোনো দোষ করছি?’ এসপি তাঁদের অভয় দিয়ে বসালেন। তিন বছর আগের সেই কথোপকথন এভাবে স্মরণ করলেন এসপি হাবিবুর রহমান।
এসপি: আপনারা কী কাজ করেন?
সরদার: জাত ব্যবসা, স্যার। সাপের খেলা দেখাই। শিঙা লাগাই।
দাঁতের পোক খোয়াই। তাবিজ-কবচ বেচি।
এসপি: দাঁতে কি আসলে পোকা পড়ে? শিঙায় কি বিষ-ব্যথা ভালো হয়?
(সবাই নিশ্চুপ) একজন বলে উঠলেন, ‘সব ধোঁকা, স্যার।’
এসপি: তাহলে করেন কেন?
সরদার: বাপ-দাদার পেশা।
এসপি: এই দিয়ে কি সংসার চলে? পাড়ার যুবকেরা কি কাজ করে?
(পিনপতন নীরবতা) মাদক বেচাকেনা হয়?
সরদার: হয়।
এসপি: মাদক আসে কোথা থেকে?
সরদার: উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে।
এসপি: কীভাবে?
সরদার: সাপের বাক্সে করে। কাঠের বাক্সভর্তি সাপ থাকে। আর বাক্সের চারপাশে ঘুপচি বানিয়ে ইয়াবা বড়ি ঢুকিয়ে আনা হয়।
এসপি: ইয়াবায় আপনাদের বাচ্চাকাচ্চারা তো সব শেষ হয়ে যাবে।
সরদার: জি স্যার। কোনো কাজ দেন, স্যার।
এরপর এসপি হাবিবুর রহমান যেন এক আশ্চর্য প্রদীপ জ্বাললেন। তাতে সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের এই আপাত-অন্ধকার অংশটি আলোকিত হয়ে উঠল। ঢাকার সাভার উপজেলার বংশী নদীর তীরে পোড়াবাড়ি, অমরপুর, কাঞ্চনপুর ও বাড্ডা গ্রামের একাংশ নিয়ে অন্তত ১৫০ বছর আগে গড়ে ওঠা বেদেপাড়ায় এখন পাকা ঈদগাহ আছে। পাড়ায় ১১টি পাকা রাস্তা হয়েছে। হয়েছে স্যানিটেশনের ব্যবস্থা। বুটিক কারখানায় কাজ করছেন বেদে নারীরা। স্থানীয় স্কুল-কলেজে বিনা বেতনে পড়ছে ৩১৭ বেদে শিক্ষার্থী। তাদের বিনা পয়সায় পড়ানোর জন্য খোলা হয়েছে কোচিং সেন্টার। ১০৩ জনের জন্য বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৪২ জন নারীকে চাকরি দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পোশাক কারখানায়। ৩৬ জন বেদে যুবককে দেওয়া হয়েছে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ। পুলিশে চাকরি করছেন তিনজন। বেদেপাড়ার ভেতরে স্কুল হচ্ছে। ভাসমান বেদেদের আবাসনের জন্য পৌনে তিন একর জমি বরাদ্দ হয়েছে। বাল্যবিবাহ কমেছে। এখন বেদেপাড়ার লোকজন জানেন, ১৮ বছর বয়সের পর বিয়ে করলে সব খরচ দেবেন এসপি হাবিবুর রহমান।
মাত্র তিন বছরে এই বিপুল পরিবর্তন বেদেপাড়াকে ‘মাদকের হাট’-এর কুখ্যাতি থেকে মুক্তি দিয়েছে। কীভাবে শুরু হলো এই কর্মযজ্ঞ—প্রশ্ন করতেই শুরু করলেন এসপি হাবিবুর রহমান, ‘তাদের কী কাজ দেওয়া যায়, তা বোঝার জন্য বেদেপাড়ায় গেলাম। পোড়াবাড়িতে একটা খোলা মাঠের পাশে সবাই জড়ো হয়েছে। সরদাররা জানালেন, এটা ঈদগাহ মাঠ। এখানে বেদে সম্প্রদায়ের (৯৮ শতাংশ মুসলিম) লোকেরা ঈদের নামাজ আদায় করেন। বললাম, আসছে ঈদে আপনারা পাকা ঈদগাহে নামাজ পড়বেন। সরদাররা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। সাভার পৌরসভার তখনকার মেয়র রেফাত উল্লাহকে খবর পাঠালাম। মেয়র এলেন একজন কাউন্সিলরকে নিয়ে। সবার সামনে তাঁর কাছে সহায়তা চাইলাম। তিনি বললেন, উন্নয়ন প্রকল্পের ৫০ লাখ টাকা তাঁর হাতে আছে। মেয়র পুরো টাকাই ১ নম্বর ওয়ার্ডে বরাদ্দের ঘোষণা দিলেন। সঙ্গী কাউন্সিলর বললেন, এই টাকা নয়টা ওয়ার্ডের জন্য এসেছে। অন্য কাউন্সিলররা মানবেন না। মেয়র বললেন, “আমরা তাঁদের বোঝাব।”’
অবশ্য এর আগে ২০০৮ সালে মাদক থেকে পাড়াকে রক্ষা করতে পোড়াবাড়ি সমাজকল্যাণ সংঘ গঠন করেন ১০৫ বেদে তরুণ। এখন এর সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম। সাধারণ সম্পাদক রমজান মাহমুদ। অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করা রমজানই এই সংঘের উদ্যোক্তা। নিজেদের মতো করে আলোচনা, মানববন্ধন, ব্যক্তি পর্যায়ে বোঝানো, উঠান বৈঠক ইত্যাদি করে তাঁরা মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করছিলেন।
তারপর কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ে রমজানদের সঙ্গে বসলেন এসপি হাবিব। জানলেন বেদেসমাজে নারীরাই মূলত কাজ করেন। তাই নারীদের কাজের ব্যবস্থা আগে করতে হবে।
যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন হাবিবুর রহমান। তিন ব্যাচে ১০৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। হাবিবুর রহমান বললেন, ‘হাত পাতলাম পরিচিতজনের কাছে। ৫০টা সেলাই মেশিন কেনা হলো। পোশাক কারখানার মালিক নাজনীন আক্তার পূর্বপরিচিত ছিলেন। তাঁকে পরিকল্পনাটা জানালাম, তিনি এগিয়ে এলেন। ২৬০০ বর্গফুট জায়গা ভাড়া নিয়ে বেদেপাড়ায় দাঁড়িয়ে গেল এক তলা বুটিক কারখানা। কাজ শুরুর পর দেখা গেল, সেলাই বাঁকাতেড়া হচ্ছে। নাজনীন বললেন, “ভাই, কাপড় তো সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।” বললাম, হোক। দরকার হলে আপনাকে এর ক্ষতিপূরণ দেব। আপনি তাদের কাজে আটকে রাখেন। মাদক বেচায় যেন ব্যবহৃত না হয় ওরা। চালু হয়ে গেল “উত্তরণ ফ্যাশন”।’
এই কারখানায় এখন যেসব নারী কাজ করেন, তাঁদের প্রতি সপ্তাহে মজুরি দেওয়া হয়। জনপ্রতি সপ্তাহে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পান একেকজন নারী। তাঁদের তৈরি পোশাক বিক্রির জন্য আশুলিয়ায় ফ্যান্টাসি কিংডমের পাশে একটি শোরুম চালু করা হয়েছে।
সম্প্রতি এই বুটিক কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ঈদ সামনে রেখে নারীরা সেলাই নিয়ে ব্যস্ত। ‘সাপের খেলা দেখাই..., শিঙা লাগাই গো শিঙা...বলে পাড়া-মহল্লায়, গ্রাম-গঞ্জে হাঁক ছাড়তেন যে বেদে নারী, সেই সাজেনুর রহমান এখন বুটিক কারখানাটির সুপারভাইজার। আরেকজন সুপারভাইজার তকলিমা বেগম।
তিন সন্তানের মা সাজেনুর প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমরা এখন সমাজে সম্মান পাই। আগে কোনো সম্মান ছিল না। বাচ্চারা স্কুলে যাইতেছে।’ দুই সন্তানের মা সুপারভাইজার তকলিমা বেগমের কাছেও পরিবর্তনের মূল সূচক ‘সমাজে সম্মান পাওয়া’।
হাবিবুর রহমান বলেন, ‘নারীদের পর নজর দিলাম শিশুদের দিকে। এদের স্কুলে পাঠাতে হবে। বেদেপাড়ায় কোনো স্কুল নেই। মা-বাবা শিক্ষিত না হওয়ায় ঘরে পড়ালেখা হয় না। ঝরে পড়তে থাকে শিক্ষার্থীরা। তাদের বিনা মূল্যে পড়ানোর জন্য একটা কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থা করলাম। সেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এসে পড়ায়। ১০৫ বেদে শিক্ষার্থী এখন সেখানে পড়ছে।’
হাবিবুর রহমান জানান, ইতিমধ্যে বিত্তবান ব্যক্তিদের সহায়তায় বেদেপাড়ায় ২৪ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে স্কুলের জন্য। আবেদন করার পর জেলা পরিষদ ভবন তৈরির জন্য ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছে।
লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে এমন তরুণদের জন্য কম্পিউটার ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাঁচটি কম্পিউটার অনুদান নিয়ে মাস দুয়েক আগে চালু করা হয়েছে উত্তরণ কম্পিউটার সেন্টার। পরিচালনা করেন পোড়াবাড়ি সমাজকল্যাণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক রমজান মাহমুদ।
রমজান জানান, অমরপুর গ্রামে ভাড়া বাড়িতে দুজন প্রশিক্ষক দিয়ে এই সেন্টারটি চলছে। এখন ৪০ জন প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
হাবিবুর রহমান জানান, সবচেয়ে কঠিন গ্রুপ বেদে যুবকেরা। এঁদের স্ত্রীরা কাজ করেন। এঁরা শুয়ে-বসে থাকেন। মাদকে জড়ানোর ঝুঁকি এঁদের সবচেয়ে বেশি। কল্যাণ সংঘের মাধ্যমে এঁদের একটা দলকে নিয়ে বসলেন তিনি। তাঁরাও কাজ করতে রাজি।
এসপি হাবিব বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে জানলাম, ব্র্যাকে ভালো ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। এর দায়িত্বে আছেন পুলিশেরই সাবেক কর্মকর্তা এ এস হোসাইন। গিয়ে ধরলাম, স্যার, একটা ব্যবস্থা করেন। তিনি জানালেন, ফ্রি করানোর জন্য কোনো বাজেট নেই। ফিরে এলাম। গেলাম এনজিও ব্যুরোর তখনকার মহাপরিচালক মো. নুরুন্নবী তালুকদারের কাছে। তিনি ভেবেচিন্তে বললেন, “একটা আবেদন করেন।” আবেদনটি তিনি ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ৩৬ জনের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিল ব্র্যাক। এদের ২৪ জন ইতিমধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্সও পেয়ে গেছে।’
বেদেপাড়ার লোকসংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। এদের ৩০ শতাংশের নিজস্ব জমিজমা আছে। বাকিরা ভাসমান। এই ভাসমান জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করা কঠিন। এদের যাতে মাথাগোঁজার একটা ব্যবস্থা হয়, সে জন্য সাবেক জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার কাছে কিছু জায়গা চান হাবিবুর রহমান। তিনি পৌনে তিন একর খাসজমি বরাদ্দ দেন। আবাসনের ব্যবস্থা হলে এদের সমাজের চলমান কাজের সঙ্গে যুক্ত করা সহজ হবে।
তাহলে বেদে সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত উপস্থিতি কি আর থাকবে না? তাদের জাত পেশা সাপ ধরা, খেলা দেখানো ইত্যাদি কি হারিয়ে যাবে?
হাবিব বললেন, ‘চেষ্টা করছি, বিনিয়োগকারী পেলে এক বা একাধিক সাপের খামার করার। সেটা করতে পারলে এদের পেশাটা টিকে থাকবে।’ তিনি জানান, ‘ঠার’ বেদেদের নিজস্ব ভাষা। এ ভাষা সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা একটি দল গঠন করে এ ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।
বেদেসমাজের এই উত্তরণে পেছনে থেকে যাঁরা আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন হাবিবুর রহমান। কথোপকথনে স্মরণ করলেন সাভারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রাসেল শেখকেও, যিনি এসপি হাবিবের সব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছেন।
এই পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে অমরপুরের ৫০০ পরিবারের মাতাব্বর শাজাহান সরদার (৬৫) প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাবিজ-কবচ, সাপের খেলা—এসবের প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমেছে। বেদেরা অভাব-অনটনে পড়েছে। ফলে বেঁচে থাকার জন্য পেশা বদল হচ্ছেই। লোভে পড়ে অনেকে মাদক ব্যবসায়ও জড়িয়েছে। এ অবস্থায় এসপি সাহেব সাহায্যের হাত বাড়ান। তিনি বলপ্রয়োগ না করে বেদে সম্প্রদায়ের লোকদের কর্মমুখী করেছেন।’
এসপি হাবিবকেও আনন্দাশ্রুতে ভাসিয়েছেন বেদেরা। তাঁরা চাঁদা তুলে পাড়ায় একটা মসজিদ করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘হাবিবিয়া জামে মসজিদ’। বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন এসপি, ‘আমি সাধারণ একজন মানুষ। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাধারণ পুলিশিংয়ের বাইরে হয়তো কিছু কাজ করেছি। তার জন্য এই সাভারে আমার নামে মসজিদ! এঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে আসে।’