‘নরওয়ে রাজ্য’ নরওয়ের সরকারি নাম। নরওয়ে রাজ্যকে নানা নামে ডাকা হয়, এই যেমন নিশীথ সূর্যের দেশ, নর্দান লাইট, অররা বরিয়ালিশ বা উত্তরের আলো। বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে নরওয়ে বিশ্বে চতুর্থ। এখানে আছে তুষারে ঢাকা মালভূমি, পর্বতমালা। বছরের একটি বিশেষ সময়ে ২৪ ঘণ্টা সূর্যের আলো বিদ্যমান থাকা। শুধু তা–ই নয়, গ্রীষ্মকালে কিছু অঞ্চলে দুই থেকে চার মাস সূর্যের আলো থাকে। মধ্যরাতের সূর্য সব থেকে ভালো দেখা যায় ২১ জুন। প্রাকৃতিক এই ঘটনাকে শ্বেতরাত বলা হয়। আমি গ্রীষ্মের সময়ই নরওয়ে ভ্রমণে গিয়েছিলাম। যে সময়ে ভ্রমণ করছিলাম, সূর্যাস্ত যেতে দেখেছি রাত ১১টায়।
সে যা–ই হোক। এখন গল্প করতে চাই, নরওয়ের রাজধানী ওসলো শহরের একটি ভাস্কর্যের পার্ক নিয়ে। নাম তার ভিগল্যান্ড পার্ক। বলা হচ্ছে বিশ্বের সব থেকে বড় ভাস্কর্যের পার্ক ভিগল্যান্ড পার্ক। নরওয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত এই পার্ক সম্পর্কে অল্প জেনেছি। সত্যি কথাটি হচ্ছে, জানতামই না ভালো করে। আমার নরওয়ের ভ্রমণ লিস্টেও ছিল না ভিগল্যান্ড পার্ক। ওসলোতে পৌঁছানোর পর হোটেলের রিসিপশন থেকে আমাকে আমার ওসলো শহরের ভ্রমণ লিস্টে ভিগল্যান্ড পার্ক অবশ্যই যুক্ত করতে বলেছেন সেখানকার অফিসার।
ওই অফিসারের কথা শুনে নিজের রুমে গিয়ে গুগলের সাহায্য নিলাম। দেখলাম অফিসার একদম ঠিক বলেছেন। পরদিন সকালের প্রথম ডেসটিনেশন ভিগল্যান্ড পার্ক। হোটেলের কাছেই ট্রাম স্টেশন থেকে ট্রামে করে রওনা করলাম। পার্কটি একটু শহরের বাইরে। ট্রামে যেতে সময় লাগল ৩০ মিনিটের মতো এবং ট্রাম গিয়ে থামে একদম পার্কের গেটের কাছে। আমাদের দেশেও মেট্রোরেল হচ্ছে। ঢাকার কাছাকাছি এ রকম ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে নিশ্চয়ই তখন খুব সহজেই যাওয়া যাবে।
ফিরে যাই ভিগল্যান্ড পার্কে। গেট দিয়ে ঢুকে বিশাল একটি চত্বর পার হয়ে মূল পার্কে প্রবেশ করতে হয়। পার্কে প্রবেশে কোনো পয়সা লাগে না। তারপর শুরু হলো ভাস্কর্যের মেলা। হেঁটে যাওয়ার একটি পথের দুই ধারে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মানবমূর্তি। এ পর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে আকর্ষণীয় উদ্যান ভিগল্যান্ড পার্ক। ভাস্কর্য এবং এ–জাতীয় বিষয় সম্পর্কে আমি খুব বেশি উৎসাহিত হই না, আমি খুব কম বুঝি এই বিষয়গুলো। ভিগল্যান্ড পার্ক ভ্রমণ আমার জন্য একটি বিস্ময়ের মতো ছিল! কারণ, ২০০টির বেশি নগ্ন মানব ব্যক্তিত্ব তার সমস্ত গৌরবময় সরলতা এবং বিভিন্ন ধরনের পোজ ও পরিস্থিতিতে আমি সীমাহীন আপ্লুত ও অভিভূত হয়েছি।
একটি একক চিন্তার ফসল ভিগল্যান্ড পার্ক। এ উদ্যান তৈরির পেছনের গল্পটা একটু বলি। একক শিল্পী গুস্তাভ ভিগল্যান্ডের অনন্য সৃষ্টি ভিগল্যান্ড পার্ক বিশ্বের বৃহত্তম ভাস্কর্য পার্ক। শিল্পী ভিগল্যান্ড এই পার্কের পরিকল্পনা শুরু করেন ১৯০২ সাল থেকে। দীর্ঘদিন কাজ করার পর ১৯২১ সালে তাঁর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। ৮০ একর জায়গাজুড়ে এই ভাস্কর্যের মেলা। এই পার্কে ২১৬টি ভাস্কর্যে ব্যবহার করা হয়েছে ৭৫৮টি ফিগার। বানানো হয়েছে ব্রোঞ্জ, গ্রানাইট আর রড দিয়ে। পার্কের মূল থিম হলো জীবন–পরিক্রমা, মানব সম্পর্ক, পুরুষ ও নারী, যুবা ও বৃদ্ধ, মানবজীবনের সারাংশ ও আবেগ, মানবজীবন ও তার শুদ্ধতম অনুভূতি। মানবজীবনের এ রকম সহজ প্রকাশ আমি আগে কখনো দেখিনি। ভিগল্যান্ড ভাস্কর্য মেলার সংগ্রহে রয়েছে ক্রন্দনরত শিশু, প্রেমময় প্রেমিক-প্রেমিকা, প্রশান্ত বয়স্ক দম্পতি এবং আরও অনেক কিছু।
পার্কের কেন্দ্রীয় বুলেভার্ড ৫৮টি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য সাজানো আছে, যে পথ আপনাকে পার্কের মূল অঞ্চলে নিয়ে যায়। পার্কের সব থেকে দর্শনীয় স্থান দুটি প্রথমে আপনি দেখতে পারেন দ্য ফাউনটেন বা ফোয়ার, অন্যটি মনোলিথ বা বড় একটি চত্বর।
দ্য ফাউনটেইন
ফোয়ারাতে দেখতে পাবেন ছয়টি দৈত্য বিশাল একটি ভ্যাসেল তাদের কাঁধে তুলে আছে। পুলের চারপাশে ২০টি গাছ রয়েছে ভাস্কর্যযুক্ত, প্রতিটি শৈশব থেকে মৃত্যু অবধি মানুষের জীবনের বিভিন্ন স্তরকে উপস্থাপন করে। ঝরনার চারপাশের মাঠটি কালো এবং সাদা গ্রানাইট মোজাইক দ্বারা বেষ্টিত। জ্যামিতিক প্যাটার্নটি প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি গোলকধাঁধার আকার দেয় এবং চিত্রিত করে যে আপনি ধৈর্যসহকারে জীবনের গোলকধাঁধা থেকে সঠিক উপায় খুঁজে পেতে পারেন।
দ্য মনোলিথ
মনোলিথটি ভিগল্যান্ড পার্কের গ্র্যান্ড সেন্টার। ১৭ মিটার লম্বা ভাস্কর্যটি পার্কের ওপরে উঁচু একটি জায়গায়। এটি একটি বিশাল গ্রানাইট ব্লক থেকে উৎকীর্ণ এবং ১২১টি মানব ব্যক্তিত্ব সমন্বিত। সব কটি মানবমূর্তি একে অপরকে সমর্থন করার প্রয়াসে জড়িয়ে ধরে আছে। মনোলিথের চারপাশে সাজানো ৩৬টি ভাস্কর্যের গ্রুপ, যা জীবন এবং সম্পর্কের চক্রকে উপস্থাপন করে।
ভাস্কর্য, সবুজ অঞ্চল এবং স্থাপত্যের মধ্যে একধরনের অদ্ভুত যোগাযোগের একটি আকর্ষণীয় দৃশ্য ভিগল্যান্ড পার্ক। ভিজল্যান্ড পার্ক একটি অনন্য জায়গা এবং অসলোতে যাওয়ার পরেও এটি মিস করা কোনোভাবেই উচিত না। এটি নরওয়ের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। সেখানে দাঁড়ালে নিজের অনুভূতিগুলো মনে হবে মানবতা, সংবেদনশীলতা ও আবেগ দ্বারা পরিবেষ্টিত। একপর্যায়ে আপনি অনুভব করবেন যে এই মূর্তিগুলো আর কাজ নয়, একেকটি মানবসন্তান।
দ্য ফাউনটেইন ছাড়াও বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ভাস্কর্য রয়েছে সেখানে। জীবনের চাকা তার মধ্যে অন্যতম, ৭টি মানব ব্যক্তিত্ব, ৪টি প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৩টি বাচ্চার মূর্তি একসঙ্গে যুক্ত করে একটি বৃত্ত তৈরি করা। কাজটি পার্কের থিম, জন্মচক্র থেকে মৃত্যুর জীবনচক্রকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করে। ভিগল্যান্ড পার্কের সিন্নাট্যাগেন (উগ্র শিশু) সর্বাধিক বিখ্যাত মূর্তি, যা ওসলোর অন্যতম প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথমে ট্যুরিস্টদের দৃষ্টিগোচর হয় যে বিষয়টি তা হলো, সব কটি মানবমূর্তিই উলঙ্গ। এ প্রসঙ্গে শিল্পী বলেন, ‘আপনি যখন মানুষের ওপর পোশাক চাপিয়ে দেবেন, তখনই ধর্ম এবং উৎস চিহ্নিত হয়। কিন্তু আপনি যখন নগ্ন থাকবেন, তখন আপনি যে কোনো জায়গার, যেকোনো সময়ের হতে পারেন।’
৮০ একর পার্কের সবটুকু অবশ্যই দেখা সম্ভব হয়নি। মনে হচ্ছিল পুরো দিন সেখানে কাটিয়ে দিই। কিন্তু ঘড়ি তাড়া দিচ্ছিল, আরও নানা জায়গায় যেতে হবে। সময় অল্প এবং বাজেটে ভ্রমণ করতে হবে। অদ্ভুত সুন্দর এক ভালোলাগা নিয়ে ভিগল্যান্ড পার্ক আর তার শিল্পীকে বিদায় জানালাম। বেরুনোর সময় শিল্পী ভিগল্যান্ডের একটি স্ট্যাচু দেখতে পেলাম। শিল্পীকে দেখে আরও ভালো লাগায় মন ভরে গেল। যেন তিনি বলছেন, ‘কেমন লাগল আমার চিন্তা?’ খুবই অনন্য।
ভিগল্যান্ড পার্ক সম্পর্কে সব তথ্য সেখানকার সুভেনির শপ থেকে কেনা একটি বই থেকে নেওয়া।
*লেখক: পর্যটক ও শিক্ষক