গত বছর ঠিক এই সময়ে ছিলাম সুন্দরবনে। শুশুকের মেলায়। সুন্দরবনের পুরো অঞ্চলে প্রতিবছর শুশুক মেলার আয়োজন করে বন অধিদপ্তর, আইইউসিএনসহ অন্যান্য সংস্থা। নদীর প্রাণ শুশুক বাঁচানোর জন্য এই উদ্যোগ। করোনাকালে এবার এই মেলা হচ্ছে না। জনসমাগম এড়াতে এবার আয়োজন করা হয় অনলাইনে। প্রতিবছর ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে মিঠাপানির ডলফিন দিবস পালন করা হয়। শুশুকের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বাড়াতেই এই আয়োজন।
শুশুক মেলার অংশ হিসেবে দুই বছর আগে আমরা ডলফিনের মতো করে একটি বড় নৌকা বানিয়েছিলাম। নৌকার ভেতর ছিল একটি ছবি প্রদর্শনী, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপসহ নানা আয়োজন। দুই বছর নৌকাটি সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছে এবং প্রায় বিশ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছে। একটি প্রাণীর জন্য সচেতনতা বাড়াতে পুরো সুন্দরবন এলাকায় এত বড় আয়োজন আর হয়নি।
বাংলাদেশে সাত জাতের ডলফিন ও এক জাতের পরপয়েস দেখার তথ্য আছে। এর মধ্যে প্রকৃত মিঠাপানির নদীর ডলফিন মাত্র একটি। এর নাম গাঙ্গেয় শুশুক বা গ্যাংস রিভার ডলফিন। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের লালতালিকায় প্রাণীটি এখন বিপন্ন। তবে বাংলাদেশে শুশুকের অবস্থা এখনো মন্দ নয়।
শুশুক ছাড়াও পৃথিবীতে মিঠাপানির ডলফিন আছে চার প্রজাতির। এর মধ্যে চীনের নদীর ডলফিন গোটা দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর নাম বাইজি। পাকিস্তানের ইন্ডাস নদীতে আছে শুশুকের আরেক জাত ভাই। অন্য প্রজাতিটি দেখা যায় আমাজন নদীতে। সর্বশেষ প্রজাতিটি হলো ইরাবতী ডলফিন। এটি প্রকৃতপক্ষে মিঠাপানির ডলফিন নয়। উপকূলীয় লোনাপানির নদীতে এগুলোকে বেশি দেখা যায়। ইরাবতী ডলফিন পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজার টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়, যার একটা বড় অংশ আছে বাংলাদেশের নদীতে।
নদীতে শুশুকের মতো উপকারী প্রাণী আর একটিও নেই। একটি জলাশয়ে শুশুক থাকা মানে ওই জলাশয়ে পর্যাপ্ত মাছ আছে, পানির গুণাগুণ আর জলীয় অবস্থা ভালো। শুশুকের প্রধান খাবার মাছ। তাই অনেকে ভাবেন, শুশুক থাকলে নদীতে মাছের সংখ্যা কমে যায়। কিন্তু শুশুক থাকলে নদীতে তার উল্টো হয়। শুশুক এমন সব প্রজাতির মাছ খায়, যেগুলো অন্যান্য মাছের বংশবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর। একটি নদীতে বেশি শুশুক থাকা মানে ওই নদীতে বেশি মাছ রয়েছে।
শুশুক হলো আমাদের নদীর প্রধানতম স্তন্যপায়ী প্রাণী। একসময় বাংলাদেশের প্রায় সব মিঠাপানির নদীতেই শুশুক দেখা যেত। এখন এর সংখ্যা কমছে। সংখ্যায় বেশি দেখা যায় পদ্মা-যমুনা ও সুন্দরবনের নদীতে। সুন্দরবনের পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় শুশুক বসবাসের উপযোগী একটি পরিবেশ পেয়েছে। এ দেশের অন্যান্য নদীতে কারেন্ট জালের দৌরাত্ম্য এতই বেশি যে শুশুকের চলাচলে খুব সমস্যা হয়। গত কয়েক বছরের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বছরে ৩০টির বেশি শুশুক মারা পড়ছে। আর শুশুকের মারা পড়ার জন্য ৮৭ শতাংশ দায়ী হলো কারেন্ট জাল।
গোটা পৃথিবীতে শুশুকের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এর মধ্যে এক সুন্দরবনেই আছে প্রায় ২২৫টি শুশুক। পদ্মা–যমুনায় আছে প্রায় ২০০টি। কর্ণফুলী, সাঙ্গু, রূপসা, সুরমা, হালদাসহ অন্যান্য নদীতে ৫০০–এর মতো ডলফিন দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশের নদীগুলোতে সব মিলিয়ে শুশুকের সংখ্যা হাজারখানেক, যা গোটা পৃথিবীর প্রায় এক–তৃতীয়াংশ।
ডলফিন বাঁচাতে সরকার এরই মধ্যে নয়টি ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। এর ছয়টি সুন্দরবনে, অন্য তিনটি পদ্মা–যমুনায়। ডলফিনের মতো একটি প্রাণী বাঁচাতে সরকারিভাবে এত অভয়ারণ্য ঘোষণা সত্যিই বিরল।
ভারতে মিঠাপানির জাতীয় প্রাণী হলো শুশুক। আমাদের দেশে নদীগুলোয় শুশুকের বিচরণ সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব মিঠাপানির ডলফিন দিবসে শুশুককে মিঠাপানির জাতীয় জলজ প্রাণী হিসেবে ঘোষণার দাবি সবার।