সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে আমরা দেশের সেবা করতে চাই, মানুষের পাশে থাকতে চাই, সমাজের নানা অসংগতি দূর করতে চাই, আর তরুণ পাঠকদের সামনে উচ্চতর আদর্শবোধ, শ্রেয়বোধ তুলে ধরতে চাই।
১৯৯৮ সালে প্রথম আলোর ঘোষিত নীতি ছিল দলনিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা, সাহসিকতা এবং দেশপ্রেম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোয় বাংলাদেশকে সর্বক্ষেত্রে বিজয়ী দেখতে চাওয়া। আর লক্ষ্য ছিল দেশের এক নম্বর কাগজ হওয়া। সেখান থেকে প্রথম আলো এখন সারা বিশ্বে এক নম্বর বাংলা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, শুধু কাগজে নয়, ডিজিটাল মাধ্যমের সব কটি শাখায় তা সক্রিয় এবং জনপ্রিয়। প্রথমআলোডটকম সারা পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা ওয়েবসাইট।
কিন্তু আরও একটা লক্ষ্য ১৯৯৮ সালের সেই শুরুর দিনগুলোতে প্রত্যেক কর্মীর মনে টগবগ করে ফুটত, তা হলো, সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে আমরা দেশের সেবা করতে চাই, মানুষের পাশে থাকতে চাই, সমাজের নানা অসংগতি দূর করতে চাই, আর তরুণ পাঠকদের সামনে উচ্চতর আদর্শবোধ, শ্রেয়বোধ তুলে ধরতে চাই। প্রথম আলোর কর্মীরা কেউ তাঁদের কাজটাকে নয়টা-পাঁচটা চাকরি হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন ভালোর সাথে, আলোর পথে দেশটাকে একটুখানি এগিয়ে নেওয়ার মিশন হিসেবে। তাই ছাপা কাগজ ও অনলাইন প্রকাশনার বাইরে প্রথম আলোর নানা সামাজিক কাজ আর প্রকাশনার সক্রিয়তা রোজ আমাদের চোখে পড়ে।
কতশত আয়োজন
প্রথম আলো কেবল একটা সংবাদমাধ্যম নয়, এটা একটা বিশ্বাস, একটা আলোর অভিযাত্রা। গণিত অলিম্পিয়াড, তারুণ্যের জয়োৎসব, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান জয়োৎসব, প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা, কৃষি পুরস্কার, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন প্রতিযোগিতা, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, বর্ষসেরা বই পুরস্কার, বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ পুরস্কার, নারী দিবস পালন এবং বিয়ে উৎসবসহ আরও কতকিছুর আয়োজন করে প্রথম অালো।
গণিত অলিম্পিয়াড থেকে শিক্ষার্থীরা যায় আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে, সোনার মেডেল, রুপার মেডেল, ব্রোঞ্জ মেডেল নিয়ে আসে দেশে। আমাদের মাথা উঁচু হয়, বুক ভরে ওঠে। গণিত অলিম্পিয়াডের মেডেল পাওয়া শিক্ষার্থীরা অনেকে পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, অনেকেই পাস করে বেরিয়ে গিয়ে সুন্দর পেশা বেছে নিয়ে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন।
মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারকে মনে করা হয় বাংলাদেশের সংস্কৃতিজগতে পুরস্কারের সবচেয়ে বড় আয়োজন। বর্ষসেরা বই কিংবা বর্ষসেরা ক্রীড়া পুরস্কার যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই দেশে-বিদেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন, ওই আকাশে উজ্জ্বল তারা হয়ে আলো দিচ্ছেন।
প্রথম আলো ট্রাস্ট
দুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, দেশ থেকে অ্যাসিড-সন্ত্রাস কিংবা মাদকের অভিশাপ দূর করার মতো কাজে প্রথম আলো নিয়োজিত আছে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। প্রথম আলো ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে (২৩ মে ২০০৯) এসব উদ্যোগ পেয়েছে আরও সংহত রূপ। ট্রাস্টের নানা কার্যক্রম চলে প্রায় বছরজুড়েই।
নারীদের ওপর অ্যাসিড-সন্ত্রাস বন্ধে সংবাদপত্রের শক্তিকে কাজে লাগানোর উদাহরণ সৃষ্টি করে ২০০৫ সালে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার লাভ করেন। পুরস্কারের ৩৩ লাখ টাকা সমান তিনটি ভাগে অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য, মাদকবিরোধী আন্দোলন ও নির্যাতিত সাংবাদিক সহায়তা তহবিলে বরাদ্দ করে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে প্রথম আলোর কর্মীরাও তাঁদের বেতন থেকে অনুদান দিয়ে যুক্ত হন এ সামাজিক কার্যক্রমে।
প্রথম আলো ২০০৭ সাল থেকেই শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে আসছে। ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্য দাতাদের সহযোগিতায় ১১০০ জন শিক্ষার্থী সহায়তা পেয়েছে অদম্য মেধাবী কর্মসূচির মাধ্যমে। প্রতিবছর সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের প্রথম নারী এ রকম ১০ জনকে বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে, তারা পড়ছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন চট্টগ্রামে। সামিট গ্রুপের সহযোগিতায় প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় দুর্গম এলাকায় ছয়টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
দেশের যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য গঠিত হয়েছে ত্রাণ তহবিল। সিডর, আইলা, আম্পান, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে অথবা শীতার্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় প্রথম আলো। সর্বশেষ আম্পান, বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকায়। এ বছর প্রায় এক কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট ও বন্ধুসভার মাধ্যমে।
রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য তহবিল গঠন করে ১০১ জনের মধ্যে ১ কোটি ১ লাখ টাকা এককালীন বিতরণ করা হয়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার শিকার পরিবারের ২০ জনের সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
নরসিংদী জেলার রায়পুরায় এনভয় গ্রুপের সহযোগিতায় ২০১৫ সাল থেকে প্রথম আলো ট্রাস্ট-সাদত স্মৃতি পল্লী প্রকল্পের কাজ চলছে। গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষকে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে এ প্রকল্পের আওতায়।
প্রথম আলো বন্ধুসভা
প্রথম আলোর তরুণ পাঠকেরা গড়ে তুলেছেন একটা অনন্য সংগঠন—বন্ধুসভা। সারা দেশে জেলা, উপজেলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে শতাধিক বন্ধুসভা। দেশব্যাপী বন্ধুসভার ৮৫ হাজার সদস্য নিজেদের আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশ ও সমাজের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। অধ্যয়নচক্র, সাহিত্য-শিল্প-আবৃত্তি-বিতর্ক-সংগীত-সংস্কৃতির চর্চা, ম্যাগাজিন প্রকাশ, স্বাধীনতা দিবস-একুশে ফেব্রুয়ারি-বিজয় দিবস-নববর্ষ উদ্যাপন, কবি-সাহিত্যিক মনীষীদের জন্ম-মৃত্যুদিবস পালন, বৃক্ষরোপণ, নানা ধরনের মানসিক উৎকর্ষের জন্য কর্মশালা, এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করা, মানবিক কিংবা সামাজিক প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া, ত্রাণকাজ—সারা দেশে বন্ধুসভার এ ধরনের কার্যক্রম সারা বছর ধরেই আলোকঝরনার মতো প্রবাহিত হতে থাকে। করোনাকালে বন্ধুরা দুস্থ মানুষকে সেবা দিয়েছে, দুই বছরে মোবাইলের মাধ্যমে সরাসরি অর্থসাহায্য করেছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা, বন্ধুদের নিজস্ব উদ্যোগে।
গণমাধ্যমের চেয়ে একটু বেশি
দেশের উত্তরাঞ্চলে আশ্বিন-কার্তিক মাসে মঙ্গা হয়, খাদ্যাভাব দেখা দেয়। প্রথম আলো বন্ধুসভার মাধ্যমে ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ নিয়ে ছুটছে। কিন্তু তাই কি যথেষ্ট! এই মঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই। প্রথম আলো কুড়িগ্রামে চলে গেল গোলটেবিল বৈঠক করতে। দেশের নীতিনির্ধারকেরা অংশ নিলেন সেই গোলটেবিলে। স্থানীয় মানুষেরা জানালেন কী কী করণীয়। ঢাকায়ও আয়োজিত হলো একাধিক আলোচনা সভা।
প্রথম আলো সংবাদপত্রের চেয়ে অনেক বেশি। আর এই সবকিছুর মূলে আছে তার স্লোগান, ‘ভালোর সাথে আলোর পথে’।
আনিসুল হক: সহযোগী সম্পাদক