রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ভারতকে নতুন প্রস্তাব দিল বাংলাদেশ। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ‘সেফ হেভেন’ বা নিরাপদ এলাকা তৈরি করে সেখানে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। ওই এলাকায় রোহিঙ্গারা নির্ভয়ে, নিরাপদে, টেকসই জীবন নির্বাহ করতে পারছেন কি না তা দেখভালের দায়িত্ব নিক মিয়ানমারের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো। সেই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে থাকুক ভারত, চীন ও আশিয়ান সদস্যভুক্ত দেশ।
ভারত সফরের সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের কাছে এই প্রস্তাবটি দিয়ে বলেছেন, ভারত যেন এই সমাধান সূত্র নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলে। গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ হাইকমিশনে তাঁর সম্মানে দেওয়া নৈশভোজের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন এ কথা জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বন্ধু রাষ্ট্ররা রোহিঙ্গাদের দেখভালের দায়িত্ব নিলে, রাখাইনে ফেরত গিয়ে তারা ভালো আছে কি না পর্যবেক্ষণ করলে, মিয়ানমার তা মেনে নিতে পারে। কারণ, ভারত, চীন বা আশিয়ান সদস্যরা মিয়ানমারের বন্ধু রাষ্ট্র। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই সমাধান সূত্র শুনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁকে বলেছেন, ‘উদ্ভাবনী (ইনোভেটিভ) প্রস্তাব।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন তাঁর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ভারতকে বেছে নিয়েছেন। তিন দিনের এই সফরে তিনি বাংলাদেশ-ভারত যুগ্ম পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) পঞ্চম বৈঠকে যোগ দেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও তিনি দেখা করেন।
নৈশভোজের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় নতুন এই প্রস্তাবের কথা জানিয়ে আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমি সুষমা স্বরাজকে বিস্তারিত সব বলি। উনি জানতে চান, কথাটা আমি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বলেছি কি না। উত্তরে আমি বলি, বলেছি, তবে সংক্ষিপ্তভাবে। শুনে মোদি ইনোভেটিভ প্রপোজাল বলে মন্তব্য করেছেন। সুষমা তখন বলেন, মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো আপনার বন্ধু। প্রস্তাবটা তাঁকে দিচ্ছেন না কেন? জবাবে বলি, বন্ধু ঠিকই, কিন্তু প্রস্তাবটা ভারতের কাছ থেকে গেলে মিয়ানমার বেশি গুরুত্ব দেবে।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশত্যাগী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের বড় বড় দেশের নেতাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন। দুশ্চিন্তামুক্ত করেছেন। কেননা, তা না হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর একটা বড় গণহত্যা ঘটে যেত। তিনি বলেন, ‘২৪ হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন, ১৮ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, সোয়া লাখ বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ১ লাখ ২০ হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়েছে, ৮ লাখ মানুষ বাংলাদেশে চলে এসেছেন। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথিবীর বড় বড় নেতাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ধনী রাষ্ট্র নয়। দেশটা ঘনবসতিপূর্ণও। এই বাস্তুচ্যুতদের ফিরে যেতে হবে। না হলে সৃষ্টি হবে অরাজকতা। অনিশ্চয়তা। মৌলবাদ মাথাচাড়া দেবে। সুষমা স্বরাজকে বলেছি, প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের কাজ সম্পন্ন না হলে এই অঞ্চল সবার জন্য নিরাপদ থাকবে না। নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ঘটবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো দরকার।’
জেসিসি বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের বিষয়েও গুরুত্ব দিয়েছেন। এই নদীগুলোর মধ্যে কয়েকটি আবার চীন থেকে প্রবাহিত। সে ক্ষেত্রে পানি বণ্টনের মীমাংসা কীভাবে হবে, দ্বিপক্ষীয় না বহুপক্ষীয়, সে বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ-ভারত যুগ্ম নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা তা ঠিক করবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সফরে আবদুল মোমেন যে অভিভূত, বারবার সে কথা তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তিনি যখন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি, তখন সমুদ্রসীমা চুক্তির বিষয়টি ওঠে। আশঙ্কা ছিল, ভারত মেনে নেবে কি না। কিন্তু দুই দেশের শীর্ষ নেতার পরিণত নেতৃত্ব অসাধ্য সাধন করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ঠিক থাকলে ছোটখাটো সমস্যা বড় হয়ে ওঠে না। মিটমাট হয়। কিন্তু সম্পর্ক ঠিক না থাকলে ছোট সমস্যাও বড় হয়ে ওঠে।’
প্রথম সফর যে অত্যন্ত ফলপ্রসূ, আবদুল মোমেন বারবার সে কথা বলেন। তাঁর কথায়, ‘আমি খুব খুশি। সফর খুব সফল।’ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ভদ্রতাবোধও তাঁকে মুগ্ধ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি যে অভিভূত, সে কথা জানিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী, অত বড় একজন অর্থনীতিবিদ, আমার বড় ভাইয়ের (সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত) যিনি ঘনিষ্ঠ, তিনি কি না আমার গাড়ির দরজা খুলে ধরে স্বাগত জানাচ্ছেন! চলে আসার সময় গাড়ির দরজা বন্ধ করে বিদায় জানাচ্ছেন! আমি অভিভূত।’