ভাঙনের ঝুঁকিতে চাঁদপুর শহর

চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ পুনর্বাসন প্রকল্প নামে তিন হাজার কোটি টাকার স্থায়ী একটি প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে এগোচ্ছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

ঝুঁকিপূর্ণ চাঁদপুর শহর রক্ষায় ডাকাতিয়া ও মেঘনা নদীর মোহনায় ফেলা হচ্ছে বালুর বস্তা। ১৭ জুন চাঁদপুর শহরের নতুন বাজার অংশের মোলহেড এলাকায়।

তিন নদীর মোহনায় অবস্থিত চাঁদপুর শহরে কয়েক বছর ধরে ভাঙন চলছে। প্রতিবছর অস্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে কেবল ঠেকনি দিয়ে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এই বর্ষায়ও শুরু হয়েছে ভাঙন। তবে এবার একটি স্থায়ী প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। তাতে কিছুটা স্বস্তি বোধ করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

২০১৯ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ৪৫০ কোটি টাকার একটি স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্প তৈরি করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। তবে তিন বছরেও তা নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কারিগরি কমিটি। তারা চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ পুনর্বাসন প্রকল্প নামে তিন হাজার কোটি টাকার স্থায়ী একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে।

চাঁদপুর শহর রক্ষায় স্থায়ী প্রকল্প নিয়ে এখনই কাজ শুরু করা প্রয়োজন। আর তা না হলে শহরের অর্ধেকসহ ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চাঁদপুর-হাইমচর রক্ষা বাঁধও তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এস এম রেফাত জামিল, নির্বাহী প্রকৌশলী, চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড।

পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় চাঁদপুর শহর। এর মধ্যে ডাকাতিয়া নদী শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। উত্তরাংশ নতুন বাজার এবং দক্ষিণাংশ পুরান বাজার নামে পরিচিত। সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের পশ্চিম অংশে মেঘনা ও পদ্মার মিলনস্থল বড় স্টেশন এলাকায় তীব্র স্রোতের কারণে ব্লকবাঁধ দেবে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এসব এলাকায় মাঝেমধ্যে বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে।

পাউবোর দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা দাঁড়িয়ে থেকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ (বালুর বস্তা) ফেলে যাচ্ছি। কিন্তু তিন নদীর ঘূর্ণিস্রোতের কারণে নদী এ অংশে ১০০ থেকে ১৫০ ফুট গভীর। এতে ব্লকবাঁধের পাথর ব্লকগুলো সরে যাচ্ছে।’

শহরের পাশে একসময় ১৮ কিলোমিটার চওড়া ছিল মেঘনা নদী। এখন তা সংকুচিত হয়ে দেড় কিলোমিটারে চলে এসেছে। পদ্মা ও মেঘনার পশ্চিমাংশে বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য চর জাগায় নদী এমন ছোট হয়ে গেছে। ফলে পানির চাপ বেড়েছে, বেগ বেড়েছে ঘূর্ণির। প্রতিবছর উচ্চ জোয়ার, ঘূর্ণিস্রোত ও প্রবল ঢেউয়ের কারণে ক্রমাগত প্রতিরক্ষা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে শহরের নতুন বাজার অংশে বড় স্টেশন মাদ্রাসা রোড থেকে মোলহেডের পুরোনো লঞ্চঘাট পর্যন্ত ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি। প্রতিদিন একটু একটু করে এই এলাকার ব্লকবাঁধের পাথর ঘূর্ণিস্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে। একই অবস্থা শহরের পুরান বাজার অংশের—ডাকাতিয়ার মুখ থেকে হরিসভা এলাকা পর্যন্ত।

তিন নদীর মোহনা তথা মোলহেডটি বর্তমানে একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। আবার রেল কর্তৃপক্ষ জায়গাটি তাদের দাবি করে ঝুঁকিপূর্ণ মোলহেডের মাত্র ২০০ গজের মধ্যে রেলস্টেশনের কাজ শুরু করেছে। মোলহেডের পাশেই মাদ্রাসা রোড এলাকায় প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক লঞ্চ টার্মিনালসহ নদীবন্দর করার প্রস্তুতি চলছে। রেলস্টেশনসংলগ্ন ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে বিআইডব্লিউটিসির স্টিমারঘাট, দেশের সর্ববৃহৎ ইলিশ অবতরণকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কয়েক শ ঘরবাড়ি রয়েছে। এ সবই এখন ঝুঁকির মধ্যে।

শহরের পুরান বাজারের দক্ষিণাংশে মেঘনার পাড়েই সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য জায়গা নির্ধারণ করে কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু নদীভাঙন রোধ করতে না পারলে সব উন্নয়নকাজই ঝুঁকির মুখে পড়বে।

চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড গত বছরের জানুয়ারি মাসে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। চাঁদপুর শহরের জটিল হাইড্রো-মরফোলজিক্যাল অবস্থা পর্যালোচনা করে বিস্তারিত সমীক্ষা করে প্রস্তাব পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়ের যাচাই কমিটি। গত বছরের ২৭ মার্চ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, আইডব্লিউএম, সিজিআইএসসহ বিভিন্ন দপ্তরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়। কমিটি একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনের আলোকে গত জানুয়ারিতে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ পুনর্বাসন প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হয়।

মন্ত্রণালয়ে যাচাই কমিটি গত মার্চে আবার সম্ভাব্যতা সমীক্ষার মাধ্যমে প্রকল্পের পরিধি এবং কারিগরি বিষয়াদি চূড়ান্ত করার পরামর্শ দেয়। সব কাজ শেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২ জুন আবার তা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।

চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম রেফাত জামিল বলেন, চাঁদপুর শহর রক্ষার জন্য জরুরি ভিত্তিতে চরগুলো কেটে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা জরুরি। পাশাপাশি শহর রক্ষা বাঁধ রক্ষায় স্থায়ীভাবে প্রকল্প নিয়ে এখনই কাজ শুরু করা প্রয়োজন। আর তা না হলে চাঁদপুর শহরের অর্ধেকসহ ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চাঁদপুর-হাইমচর রক্ষা বাঁধও তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) রেজাউল মোস্তফা কামাল বলেন, চাঁদপুর শহরটি খুবই স্পর্শকাতর স্থান। সেখানে যেনতেনভাবে কোনো প্রকল্প নেওয়া যাবে না। তার আগে বিস্তারিত সমীক্ষা, পর্যালোচনা দরকার। সে কাজ চলছে।