ভবন উঁচু হচ্ছে, চাপ বাড়ছে

>

• বহুতল ভবন নির্মাণের হার সবচেয়ে বেশি দুই সিটি এলাকায়
• অপরিকল্পিত সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ফলে জনঘনত্ব বাড়ছে
• পানি ও গ্যাসের মতো নাগরিক পরিষেবায় চাপ বাড়ছে
• ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

ঢাকা মহানগরে ১০ বছরের ব্যবধানে ছয়তলার ওপর ভবন নির্মাণের হার বেড়েছে প্রায় ৫১৪ শতাংশ। উঁচু ভবন তৈরির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জায়গা ছাড়া হচ্ছে না। ফলে জনঘনত্বের পাশাপাশি বাড়ছে যানজট। পানি ও গ্যাসের মতো নাগরিক পরিষেবায় চাপ বাড়ছে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চলমান ও প্রক্রিয়াধীন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) তথ্য বিশ্লেষণ করে বহুতল ভবন নির্মাণের এই চিত্র পাওয়া গেছে।

বহুতল ভবন নির্মাণের হার সবচেয়ে বেশি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায়। বকশীবাজার এলাকাটি পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডটির স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ১০ বছর আগে বকশীবাজার এলাকাসহ পুরো ওয়ার্ডেই একতলা-দোতলা, টিনশেড বাড়ি ছিল বেশি। এখন সেগুলো ভেঙে বহুতল করা হয়েছে। আগে এলাকায় স্থানীয় লোকজন বেশি ছিলেন। এখন বাইরের লোকই বেশি থাকেন। শীতে ওয়াসার লাইনে পানি থাকে না, বেলা তিনটা পর্যন্ত গ্যাস আসে না।

রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, ওয়ার্ডটির গ্রহণযোগ্য জনঘনত্ব (সর্বোচ্চ) হওয়ার কথা প্রতি একরে ১১৭ জন। কিন্তু সেখানে প্রতি একরে বাস করেন ৫৮৩ জন। ভবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা হওয়া উচিত পাঁচতলা। কিন্তু ৪৩ দশমিক ২৩ শতাংশ ভবনের উচ্চতা ছয়তলার ওপরে (হাইরাইজ বা সুউচ্চ ভবন)।

জানতে চাইলে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি এলাকার নাগরিক পরিষেবা ও সড়কের নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা আছে। ভবনের অতিরিক্ত উচ্চতার কারণে জনঘনত্ব বাড়ে। এতে এলাকা ধারণক্ষমতা হারায়। এই ঘাটতি মেটানোর জন্য পরিষেবা, রাস্তাঘাট বাড়ানো হয়। কিন্তু তারও একটি সীমা আছে।

রাজউকের চলমান ড্যাপের অংশ হিসেবে করা এক জরিপ থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালে রাজউক এলাকায় মোট স্থাপনার সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৯৬ হাজার ৪১২টি। সে সময় ছয়তলার ওপরে ভবনের সংখ্যা ছিল ২ হাজর ৭৫৮টি, যা মোট স্থাপনার শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ।

অন্যদিকে রাজউকের প্রক্রিয়াধীন ড্যাপের ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, মোট স্থাপনার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ৪৭ হাজার ১৭৪। আর ছয়তলার ওপরে ভবনের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৯৩০; যা মোট স্থাপনার শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ। ১০ বছরের ব্যবধানে সুউচ্চ ইমারত নির্মাণের হার বেড়েছে ৫১৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

এভাবে ভবনের উচ্চতা বৃদ্ধির পেছনে ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালাকে দুষছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সহসভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন। তিনি বলেন, ইমারতগুলো নির্মাণ করা হয়েছে ২০০৮ সালের বিধিমালায় উল্লেখ করা ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার)’ অনুযায়ী। পুরো ঢাকা শহরের জন্য একই ফার হতে পারে না। যে এলাকায় জনঘনত্ব বেশি সেখানে ফার কম হবে, আর যেখানে জনঘনত্ব কম সেখানে ফার বেশি হবে।

১৯৯৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, ছয় মিটার রাস্তার পাশে দুই কাঠার জমিতে সর্বোচ্চ পাঁচতলা ভবন নির্মাণের সুযোগ ছিল। ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় একই পরিমাণ জমিতে নয়তলা ভবন তৈরির সুযোগ রয়েছে। এর বাইরেও বিধি অমান্য করে ভবনের আকৃতি বা উচ্চতা বাড়ানোর ঘটনা ঘটছে অহরহ। রাজউকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মে মাসে সংস্থাটির আটটি জোনে ৩ হাজার ২৮৮টি ভবন পরিদর্শন করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ২৮৮টি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেই নিয়ম মানা হয়নি।

অপরিকল্পিত সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ফলে জনঘনত্ব বাড়ছে। এতে চাপ পড়ছে নাগরিক পরিষেবার ওপর। ঢাকা ওয়াসার পানির শতকরা ৭৮ ভাগই আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। কিন্তু প্রতিবছর ঢাকায় পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে। বাড়তি মানুষের চাহিদা মেটাতে আরও পানি তুলতে হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পনাবিদদের মতে, ঢাকা শহরে সুন্দরভাবে চলাচলের জন্য শহরের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকা শহরে রাস্তা আছে মাত্র ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। গত ১০ বছরে রাস্তার আয়তন সেভাবে বাড়েনি। কিন্তু বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৫০০।

তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী, এর অন্তর্ভুক্ত এলাকায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা থাকে ২১০ কোটি ঘনফুট। প্রতিদিন সরবরাহ থাকে ১৭০ থেকে ১৭৫ কোটি ঘনফুট। সে অনুযায়ী প্রতিদিন প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকে। এর প্রভাব পড়ছে ঢাকা শহরেও।

ঢাকা শহরে জমিসংকটের কথা বলে অনেকেই সুউচ্চ ভবনের পক্ষে মত দেন। এ সম্পর্কে পরিকল্পনাবিদ ফজলে রেজা বলেন, ভবন উঁচু করার ক্ষেত্রে জনঘনত্ব যাতে না বাড়ে, সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ধরা যাক, এক বিঘা জমিতে পাঁচতলাবিশিষ্ট পাঁচটি আলাদা ভবনে ১০০টি ফ্ল্যাট আছে। সেখানে ১০০টি পরিবার বাস করবে। এখন এই ১০০টি পরিবারের জন্য ২৫ তলা একটি ভবন তৈরি করে বাকি জায়গা ফাঁকা রাখলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু পাঁচটি ভবনই যদি ২৫ তলা করে তৈরি করা হয়, তবে ওই এক বিঘা জমিতে বাস করবে ৫০০ পরিবার। এতে স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার নাগরিক পরিষেবার মান কমবে। তিনি বলেন, কোনো ভবনই ফাঁকা থাকবে না। বরং জায়গা না পেলেই মানুষ ছড়িয়ে পড়বে।