বয়স্কদের ঝুঁকি বেশি, টিকা পাচ্ছেন কম

৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি। টিকার ১৭ শতাংশ পেয়েছেন এই বয়সীরা।

সকাল নয়টায় টিকা দেওয়া শুরু হয়। মানুষজন এসে অপেক্ষা করেন অন্তত এক ঘণ্টা আগে থেকে। সকাল সাড়ে ১০টায় গিয়ে টিকা নিতে আসা মানুষের এমনই ভিড় লক্ষ করা যায়। গতকাল খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে।

বয়স্ক ও অন্য রোগে ভুগছেন এমন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলে তাঁদের জটিলতা বেশি হয়। করোনায় এমন বয়সীদের মৃত্যুহারও বেশি। ঝুঁকিপূর্ণ এসব মানুষ করোনার টিকা কম পাচ্ছেন। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৫৫ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের বেশি। এ পর্যন্ত দেওয়া টিকার ১৭ শতাংশ পেয়েছেন এই বয়সীরা।

আইসিটি বিভাগ ১৩ আগস্ট পর্যন্ত নিবন্ধনকৃত ও টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যান তৈরি করেছে। তাতে দেখা যায়, প্রবীণ নাগরিকদের মধ্যে নিবন্ধনের পরিমাণও তুলনামূলকভাবে কম। তুলনামূলকভাবে ঝুঁকি কম এমন মানুষ নিবন্ধন করেছেন বেশি, তাঁরা তুলনামূলকভাবে টিকাও পেয়েছেন বেশি। দেখা গেছে, নিবন্ধনকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ শতাংশের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স্ক ব্যক্তিরা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগসহ নানা ধরনের দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগেন বেশি। এসব রোগে ভুগতে থাকা ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলে তাঁদের মধ্যে করোনার তীব্রতা বেশি দেখা যায় এবং মৃত্যুহারও তাঁদের বেশি।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, বয়স্ক মানুষদের টিকার আওতায় আনলে হাসপাতালে ভর্তির পরিমাণ কমবে, অনেক মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হবে।

বয়স্ক মানুষদের টিকার আওতায় আনলে হাসপাতালে ভর্তির পরিমাণ কমবে, অনেক মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হবে।
আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ

টিকাদানের উদ্দেশ্য

শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে টিকা দেওয়া হয়। কোনো কোনো টিকার নির্দিষ্ট ডোজ দেওয়া হলে সারা জীবন সুরক্ষা পাওয়া যায়। মূলত টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ব থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু করোনার টিকার ক্ষেত্রে আজীবন সুরক্ষার বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করতে পারেননি টিকা বিজ্ঞানীরা।

এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত ও ব্যবহৃত টিকা করোনাভাইরাসের সব ধরন বা ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রে সমানভাবে কাজ করবে কি না, তা নিয়েও বিজ্ঞানীদের মধ্যে সন্দেহ আছে। ভবিষ্যতে নতুন কোনো ভেরিয়েন্টের আবির্ভাব ঘটলে এখনকার টিকাগুলো কতটা কাজে লাগবে তা নিয়েও আলোচনা আছে। করোনা থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তি দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন নজির দেশে-বিদেশে আছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় দুই ডোজের পর তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে মাত্র ৪ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ পূর্ণ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, টিকা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারছে না। এখন টিকা দেওয়ার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত রোগের তীব্রতা কমানো, মৃত্যুঝুঁকি কমানো। সুতরাং যাঁদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি, তাঁদের টিকার আওতায় আনতে হবে।

যাঁদের মৃত্যু বেশি

গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাব বলেছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এঁদের মধ্যে ৪৩ জনের অর্থাৎ অর্ধেকের বেশির বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি।

অধিদপ্তরের তথ্য আরও বলছে, এ পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ২৫ হাজার ৯২৬ জনের। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি।

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলে করোনায় মারা যাওয়া ২০০ রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসক ও গবেষকেরা। তাতে দেখা গেছে, এঁদের গড় বয়স ছিল ৬২ বছর। ৬১ থেকে ৭১ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যু বেশি। মৃতদের ৬৪ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ ও ৫৬ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন।

যাঁদের নিবন্ধন ও টিকা কম

করোনা টিকাদানের শুরুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছিল, নির্দিষ্ট কিছু পেশার সম্মুখসারির কর্মী ও ৫৫ বছর বয়সীরা নিবন্ধন ও টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন। ৭ ফেব্রুয়ারি টিকা দেওয়ার শুরুর দুই দিন পরই সরকার বয়সসীমা কমিয়ে ৪০ বছর করে। এরপর বিভিন্ন সময় সরকার বয়সসীমা ৩৫, ৩০ ও ২৫ বছর করেছে।

বয়স যত কমেছে, প্রবীণেরা নিবন্ধনের ক্ষেত্রে তত পেছনে পড়েছেন। আইসিটি বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, মোট নিবন্ধনের ৪১ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের কম। এ পর্যন্ত এই বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুহার ৯ শতাংশ। আর টিকার ৩২ শতাংশ পেয়েছেন এই বয়সীরা।

এ ব্যাপারে করোনার টিকাবিষয়ক কমিটির প্রধান অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অগ্রাধিকার পাওয়া পেশাজীবীদের মধ্যে একটি বড় অংশ বয়সে তরুণ। সেই কারণে এই বয়সীদের নিবন্ধন শুরু থেকেই বেশি দেখা গেছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মানুষ কম টিকার আওতায় আসছেন, সেটি নিয়ে তাঁরাও চিন্তিত। তবে দেশব্যাপী তাঁদের বেশি টিকার আওতায় আনার জন্য কীভাবে কাজটি করা হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কৌশল এখনো ঠিক হয়নি।