অন্তর্জালে পরিচয়ের একেবারে শুরুতে ছোট্ট একটা অনুরোধ এসেছিল, ‘দয়া করে আমাকে স্যার ডাকবেন না। আমি কোনো স্যার নই।’ তারপর বেশ কিছুদিন ই-মেইল চালাচালির পর এল আরেকটি বিনীত অনুরোধ, ‘প্লিজ, এমনভাবে লিখবেন না, যাতে লোকে ভাবে, মুই কী হনু রে। আপনার লেখায় আমি যেন নিচু স্বরে থাকি। এসব ভারি বিব্রতকর।’
একজন মানুষকে বুঝতে এই ছোট্ট দুটি অনুরোধই যথেষ্ট। এমন একজন মানুষ, যাকে কিনা আমরা বেছে নিয়েছি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একজন সফল ও মেধাবী বিজ্ঞানীর পরিচয়ে আমাদের প্রেরণাদায়ক হিসেবে। তাঁকে বেছে নেওয়ার জন্য উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করায় তিনি ‘সফল’, ‘মেধাবী’ ইত্যাদি শব্দ সম্পর্কে তাঁর মতামত জানান। যেমন প্রথমত, বিজ্ঞানের জগতে সফলতা শব্দটির গুরুত্ব নেই। আজ যাতে ব্যর্থতা বা সাফল্য বলা হচ্ছে, কাল তা না-ও থাকতে পারে। বিজ্ঞানের আবিষ্কারে যেকোনো সাফল্য শত শত ব্যর্থতার সমষ্টি। দ্বিতীয়ত, মানুষ মাত্রই মেধাবী। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ অপরিসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়। কিন্তু সুযোগ আর পরিবেশের কারণে কেউ তার সম্ভাবনা মেলে ধরার সুযোগ পায়, কেউ পায় না বলে তার সম্ভাবনা হারিয়ে যায় অন্ধকারে।
তাহলে সফল বা মেধাবী—এই শব্দগুলো আপেক্ষিক। তাই বিশেষণগুলো সরিয়েই আলাপে নামতে হলো। আমরা বরং একজন সহজ সাধারণের পথ পরিক্রমার কথা শুনি।
দুই.
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লোরি ইনস্টিটিউটের ইনসুলিন পেপটাইডস ল্যাবরেটরির প্রধান মোহাম্মদ আখতার হোছাইন। বিশ্বে একমাত্র তাঁর দলটিই পেপটাইড ও তার গ্রহণকারীর মধ্যে যোগাযোগের জটিল প্রক্রিয়াটি সহজতর করতে বিশেষ ধরনের পেপটিডোমাইমেটিক অ্যাগোনিস্ট তৈরিতে সফল হয়েছে। বিশ্বে একমাত্র তাঁর গবেষণাগারেই সিস্টিনসমৃদ্ধ ইনসুলিন ও নানা ধরনের পেপটাইড তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এই মুহূর্তে তাঁর অধীনে নয়জন পিএইচডির ছাত্র ও চারজন পোস্ট ডক্টরাল ফেলো এসব জটিল রাসায়নিক কাজে নিরন্তর সাহায্য করে যাচ্ছেন।
বিশ্বজুড়ে রসায়ন ও প্রাণরসায়নের নানা আন্তর্জাতিক অভিজাত জার্নালে ১১০টি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে আখতারের। ইনসুলিন জাতীয় পেপটাইড তৈরির বিষয়ে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশে তিনি বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবন্ধকার। এ বিষয়ে অন্তত পাঁচটি মৌলিক আবিষ্কারের পেটেন্টে অংশীদারি আছে তাঁর।
ইনসুলিন-জাতীয় পেপটাইড-৫ নামে যে হরমোনটি বৃহদন্ত্র থেকে তৈরি হয়ে আমাদের ক্ষুধা, রুচি ও অন্ত্রে খাদ্যের চলনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে, গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে তা প্রথম তৈরি করেন আখতার। এখন স্থূলতা কমাতে ও ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করতে হরমোনটির প্রায়োগিক ব্যবহার নিয়ে তিনি কাজ করছেন। কাজ করছেন মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করতে পারে এমন আরেক পেপটাইড রিলাক্সেন-৩ নিয়ে। হাঁপানি, ফুসফুসের ফ্রাইব্রোসিস ও নারীদের প্রি-একলাম্পশিয়ায় ব্যবহার করা যাবে এমন আরেক পেপটাইড রিলাক্সেন-২ বিকশিত হতে যাচ্ছে এই বিজ্ঞানীরই হাতে। রেফ্রিজারেটর ছাড়া ইনসুলিন সংরক্ষণ করার পদ্ধতিও তাঁর আবিষ্কার।
এই তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। এই আঙিনা সম্পর্কে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা আখতার হোছাইনের নাম ভালো করেই জানেন। কিন্তু আমরা যা জানতে চাই তা হলো কোন ঘোরে, কোন পথে, কোন আলো অনুসরণ করে কুমিল্লার অলিপুর গ্রামের ধনুয়াখোলা মাদ্রাসার এই ছাত্র আজ প্রাণরসায়নের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বচ্ছন্দে ও সগর্বে বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন। কোন স্বপ্ন তাঁকে এত দূর টেনে এনেছে।
তিন.
স্বপ্ন। হ্যাঁ, এই শব্দটা তাঁর পছন্দ। তিনি বলেন, স্বপ্ন দেখতে হবে বড় বড়। ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে বড় স্বপ্ন দেখা যায় না। স্বপ্নই মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় সামনের দিকে।
মাত্র দুই বছর বয়সে মা মারা যান আখতারের। নিজেও পড়েছিলেন এক কঠিন অসুখে। দাদির কাছে মানুষ। বড় হয়ে শুনেছেন, কেউ বলেছিল, এই ছেলে সুস্থ হলে তাকে যেন মাদ্রাসায় পড়তে দেওয়া হয়। সেই পথেই চলছিলেন তিনি। ধনুয়াখোলা মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় কুমিল্লা জেলায় প্রথম হলে কাকা তাঁকে নিয়ে ভর্তি করালেন কুমিল্লা আলিয়া মাদ্রাসায়। কারণ ওখানে বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ আছে। সেটাই তাঁর জীবনের প্রথম বাঁক। সারা জীবন অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা চালিয়েছেন।
দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলেন প্রাণরসায়ন বিভাগে। জীবনের আরেকটা বাঁক এই বিষয় নিয়ে পড়তে পারা। আশ্চর্যের বিষয়, মাদ্রাসায় জীববিজ্ঞান পড়ার সুযোগ ছিল না বলে ভর্তি পরীক্ষায় অনেক বিষয়েই টিক মার্ক দিতে পারেননি তিনি। কী অদ্ভুত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের, এখন পেছন ফিরে ভাবেন। পরবর্তী সময়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুটিতেই প্রথম শ্রেণি পেয়ে জাপান সরকারের মনবুসো বৃত্তি পেয়ে পিএইচডি করতে চলে যান টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। পোস্ট ডক্টরেট করেন ফ্রান্সের জোসেফ ফুরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৫ সালে যোগ দেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে এসে থিতু হন পেপটাইড নিয়ে নানামুখী গবেষণায়।
সফলতার প্রসঙ্গে একটা গল্প বলা যাক।
৪০ বছর আগে জেফ্রি ট্রিগার নামে এক বিজ্ঞানী হিউম্যান রিলাক্সেন-২ নামে একটি পেপটাইড আবিষ্কার করেন। ধারণা করা হয়, সেটি হার্ট ফেইলিউরের চিকিৎসায় যুগান্তকারী সাফল্য বয়ে আনবে। তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে ১২ বছর ধরে যুক্ত আখতার। দীর্ঘ সাধনার পর সম্প্রতি ৭ হাজার মানুষের ওপর এই ওষুধের ফেইজ থ্রি বি ট্রায়াল সমাপ্ত হয়েছে। ফলাফল কী জানেন? হৃৎপিণ্ডের চিকিৎসায় আশাব্যঞ্জক ফলাফল দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে তাঁর এক যুগের এই সাধনা।
ওই যে শুরুতেই বলেছিলাম, বিজ্ঞানের সাফল্য আসে বন্ধুর, অমসৃণ ও নির্মম পথে। এখানে প্রতিটি সফলতার পেছনে থাকে শত ব্যর্থতার করুণ ইতিহাস। তাই বলে কি হাল ছেড়ে দেওয়া যায়? ইকারুসের ডানা ভস্মীভূত হওয়ার পরও মানুষ উড়তে শিখেছে। এটাই বিজ্ঞানের পথ।
চার.
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ গবেষণা আর গবেষণা। আখতার মনে করেন, এই জায়গাটিতে যত দিন না কোনো পরিবর্তন আসছে, তত দিন বাংলাদেশের ফলপ্রসূ অগ্রগতি হবে না। অর্থনৈতিক বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন আসল উন্নয়ন নয়। প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি মানুষের মনে, অপ্রতিরোধ্যভাবে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পে, নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায়। ভারত আর চীন এটি বুঝতে পেরেছে। তারা মৌলিক গবেষণায় কোটি কোটি টাকা বাজেট করতে শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিণত করেছে গবেষণার সূতিকাগারে। আমাদের এখনো টনক নড়েনি।
আখতার হোছাইন স্বপ্ন দেখেন, মানবজাতির কল্যাণে কাজে আসে এমন যুগান্তকারী মৌলিক গবেষণা একদিন বাংলাদেশের তরুণদের হাতেই হবে। গণিত বা বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড না হলে কি আমরা জানতে পারতাম, আমাদের তরুণদের এত সম্ভাবনা আছে! এই মেধা গবেষণার কাজে না লাগাতে পারলে দেশ পাল্টাবে না।
হ্যাঁ, আখতার আবারও মনে করিয়ে দিতে ভোলেন না, ব্যক্তির সাফল্য কোনো বিষয় নয়। বিজ্ঞানের বিশাল মহাসমুদ্রে ধূলিকণার মতো। কিন্তু সমষ্টিগত প্রচেষ্টা একটি জনগোষ্ঠীকে আমূল পাল্টে দিতে পারে। তরুণ প্রজন্মকে সেই পথটা দেখানোই আমাদের কর্তব্য।
তানজিনা হোসেন: চিকিৎসক; কথাসাহিত্যিক।
আখতার হোছাইনের কর্মধারা
গবেষণা
আন্ত্রিক হরমোন ইনসুলিন জাতীয় পেপটাইড-৫
হাঁপানি ও ফুসফুসের ফাইব্রোসিস রোগে কার্যকর পেপটাইড রিলাক্সেন-২
মানসিক উদ্বেগ প্রশমনে সক্ষম হরমোন রিলাক্সেন-৩
প্রকাশনা
রসায়ন ও প্রাণরসায়নে গবেষণা প্রবন্ধ ১১০
ইনসুলিন লাইক পেপটাইড তৈরি নিয়ে বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রবন্ধকার