বছরের প্রথম দিনে স্কুলে স্কুলে বই উৎসব হবে। চোখে যারা দেখতে পায়, সেই শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যের নতুন বই নিয়ে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু তাদেরই সহপাঠী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলে কিংবা মেয়েটি আঙুল বুলিয়ে পড়ার উপযোগী কোনো বই হাতে পাবে না।
সরকারের ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কর্মসূচির আলোকে প্রতিবন্ধীসহ স্কুলগামী সব শিশুই বিনা মূল্যে পাঠ্যবই পাওয়ার দাবিদার। অথচ সরকারি যেসব স্কুলে প্রতিবন্ধীদের জন্য সমন্বিত শিক্ষার বিশেষ কার্যক্রম আছে, এখন শুধু সেগুলোতেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পড়ার উপযোগী ব্রেইল-পদ্ধতিতে ছাপানো পাঠ্যবই যায়। তা-ও অনেক দেরিতে।
এ বছর এসব স্কুলে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ব্রেইল-বই পেয়েছে ফেব্রুয়ারির শেষভাগে। তবে গণিতের বইটি বাদে। আর এপ্রিল শেষ হলেও মাধ্যমিক পর্যায়ের অধিকাংশ বিষয়ের ব্রেইল-বই ছাপাই হয়নি। কবে হবে তা অনিশ্চিত।
বেসরকারি স্কুলের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা কি প্রাথমিকের, কি মাধ্যমিকের, সরকারিভাবে ছাপা ব্রেইল-বই কখনোই পায় না। এবারও পায়নি। একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত কিছু ব্রেইল-বই বাজারে মেলে। কিন্তু দাম চড়া।
প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারের সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রমটি চালায় এবং ব্রেইল-বই ছাপিয়ে বিলি করে সমাজসেবা অধিদপ্তর। টঙ্গীতে অবস্থিত দেশের একমাত্র সরকারি ব্রেইল-ছাপাখানার মুদ্রণযন্ত্রটি গত ডিসেম্বর থেকেই নষ্ট। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, অধিদপ্তর মনে করছে আগামী এক বছরেও এটি সারানো যাবে না। এবারের কাজ কোনোমতে চলছে একটি বেসরকারি সংগঠনের দেওয়া মুদ্রণযন্ত্রে।
লালমনিরহাটের সাপ্টিবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে। সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ১১ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলে পড়ছে। স্কুলটির একজন শিক্ষক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূলধারায় আনতে সমান অধিকারের কথা বলা হচ্ছে। অথচ এদের বছরটা শুরুই হচ্ছে বৈষম্যের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর জন্য গণিত বাদে অন্যান্য বিষয়ের সব বই এসেছে। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণীর জন্য মাত্র একটি বিষয়ের এবং অষ্টম শ্রেণীর জন্য ১৩টির মধ্যে মাত্র তিনটি বিষয়ের বই পাঠানো হয়েছে। অধিদপ্তর এক প্রস্থ বই অন্তত তিন বছর চালাতে বলেছে। কিন্তু ভারী হওয়ায় ব্রেইল-বইগুলো এক বছরেই ছিঁড়ে যায়।
সিলেট ও রংপুর বাদে দেশের অন্য পাঁচটি বিভাগীয় শহরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় শ্রবণ-দৃষ্টি ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি করে বিশেষ স্কুল রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি জেলায় একটি স্কুলে সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম থাকার কথা, যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও পড়ার সমসুযোগ পাবে। কিন্তু ৬৪ জেলার মধ্যে মাত্র ২৮ জেলায় এটা চালু আছে।
সবগুলো স্কুল মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজার ২০০। এদের ব্রেইল-বই জোগাতেই অধিদপ্তর হিমশিম খায়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রতিবছরই একই ভোগান্তি।
চট্টগ্রাম শহরের সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ছে ২৭ জন ছেলেমেয়ে। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মো. আবদুস সামাদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছর বইয়ের এই সংকট লেগেই আছে। বাচ্চারা হইচই করে—স্যার, কবে বই দেবে? কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, শিক্ষক হিসেবে ওদের এ প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না।’
এদিকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি বই মোটেই পায় না। সাভারের ‘স্যালভেশন আর্মি ইন্টিগ্রেটেড চিলড্রেনস সেন্টার’-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জগৎ রায় বললেন, ‘সমাজসেবা অধিদপ্তরে গত বছরেও আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো উত্তর নেই।’ রংপুরের ‘রাইট টু সারভাইভ’ স্কুলের শিক্ষিকা রুবি আক্তার নিজেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তিনি বলছেন, দুই বছর আগে অধিদপ্তর তাঁর ছাত্রছাত্রীদের একটি তালিকা নিয়ে আর কিছু জানায়নি।
অচল, অদক্ষ, অসমন্বিত, অবহেলিত: সমাজসেবা অধিপ্তরের সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রমটির পদস্থ এক কর্মকর্তা বলছেন, দেশের সব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য বই ছাপানোর ক্ষমতা সরকারের একমাত্র ব্রেইল ছাপাখানাটির নেই। তার ওপর এর মুদ্রণযন্ত্রটি গত ডিসেম্বর থেকেই অচল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মকর্তাটি বলেন, যেকোনো যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সেটিকে মন্ত্রণালয়ের টেব্ল অব অরগ্যানোগ্রাম অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট (টিওই) তথা সাজ-সরঞ্জামের তালিকাভুক্ত হতে হয়। টঙ্গীর ব্রেইল-মুদ্রণযন্ত্রটি এই তালিকায় নেই। তাই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রেসটির দায়িত্ব নিতে চায় না।
গোড়ায় গলদ: জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফোরামের পরিচালক ড. নাফিসুর রহমানের মতে, ব্রেইল-পাঠ্যবই ছাপানো এবং বিলি-বণ্টনের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিলেই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে। যতক্ষণ এটা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবে ততক্ষণ এটা কেবলই কল্যাণের প্রশ্ন থেকে যাবে। তাই সমাধানও হবে না।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) এ এস মাহমুদের সভাপতিত্বে এক সভায় এনজিও এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় এনসিটিবির মাধ্যমে ব্রেইল-বই ছাপানোর ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। আপাতত সংকট কাটাতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা ১২টি এনজিওকে সম্পৃক্ত করে সমঝোতার কথাও বলা হয়েছে। এ ছাড়া মুদ্রণ খরচ বিবেচনায় নিয়ে বাজেট বরাদ্দ চাওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এসব কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়াই হয়নি, বলছে খোদ অধিদপ্তরের সূত্র।