পাখির বসবাসের জন্য নিরিবিলি জায়গা ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন, এই ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত করে জনাকীর্ণ হাটের মধ্যে কয়েক শ পাখি বাসা করেছে। মানুষ আর পাখির এমন সহাবস্থান অসম্ভব নয়, দুর্লভ।
রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম অন্নদানগর। সেখানে সপ্তাহে দুদিন হাটও বসে। আর অন্যান্য দিনের সারাটা সময়েই জমজমাট কেনাকাটা। বিকেল হলে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। করোনাকালেও এই বাজারের ব্যস্ততা কমেনি। এ রকম ব্যস্ততম একটি বাজারেই কয়েক শ পাখির বাস।
সম্প্রতি এক হাটবারে মানুষের পা ফেলার জায়গা নেই, এমন দিনে অন্নদানগর হয়ে রংপুরের পীরগাছায় তিস্তা নদীর অবস্থা দেখতে যাচ্ছিলাম। অন্নদানগরের ভেতরে ঢুকেই চোখ চড়কগাছ। মাঝারি ধরনের একটি পাকুড়গাছ। সবুজ আচ্ছাদনের ওপর সাদা বক আর কালো পানকৌড়ির যেন বিশাল সমাবেশ। গাছভর্তি অগণিত পাখির বাসা।
সেদিন সহযাত্রী ছিলেন সহকর্মী নুরুজ্জামান। তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং অন্নদানগর হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি জানালেন, স্থানীয় দোকানদারদের ভালোবাসায় পাখিগুলো প্রতিবছর এখানে আসে।
অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তাঁরা পাখিদের মাধ্যমে সৃষ্ট সব অসুবিধাই মেনে নিয়েছেন। গাছের নিচেই দোকান পল্লিচিকিৎসক নুরুল ইসলামের। তিনি বললেন, ‘প্রায় প্রতিদিন আমাদের অনেকের শরীরে একটু না একটু ময়লা লাগেই।’ ঝাড়ুদার রেখে ব্যবসায়ীরা সেসব পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করছেন। রমিজ আলী নামের একজন জানালেন, একবার কয়েকজন দোকানদার গাছটি কাটার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে অধিকাংশ দোকানদার এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) খবর দেওয়া হয়। পরে তিনি এসে গাছ কাটা বন্ধ করেন এবং গাছটি পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করেন।
বটগাছে বক-পানকৌড়ির স্থানসংকুলান না হওয়ার কারণে পার্শ্ববর্তী একটি আমগাছেও তারা বাসা করেছে। গত বছরের চেয়ে এবার পাখি এসেছে বেশি। চারদিকে অসংখ্য দোকান। মানুষ গিজগিজ করছে। হাটের দিনে জনসমাগম হয় অনেক বেশি। স্থানীয় এক দোকানি বললেন, ‘আমরা বাজরের সবাই এই পাখি দেখে রাখি। কেউ একটি পাখিকেও বিরক্ত করতে পারবে না। পাখি যত দিন আসবে আমরা তত দিন পাখির পাশে আছি।’
১৫-২০ বছর ধরে এখানে এসব পাখি আসে। প্রতিদিন এদের দেখি, তবু বারবার দেখতে ইচ্ছা করে। দেখার আনন্দ শেষ হয় নানুরুল ইসলাম, পল্লিচিকিৎসক
পল্লিচিকিৎসক নুরুল ইসলাম বললেন, ‘১৫-২০ বছর ধরে এখানে এসব পাখি আসে। প্রতিদিন এদের দেখি, তবু বারবার দেখতে ইচ্ছা করে। দেখার আনন্দ শেষ হয় না।’ একজন বৃদ্ধ বললেন, আশপাশে অনেক বিল আছে। কাছেই আছে তিস্তা ও মানাস নদী। সে কারণে এখানে পাখিরা আসে।
পাখিদের দারুণ জীবনাচরণ। প্রথমে পাখিগুলো এসে বাসা বুনতে থাকে। তারপর ডিম দেয়, বাচ্চা ফোটে। বাচ্চাগুলো ক্রমে বড় হতে থাকে। উড়তে শেখার সময়ে কিংবা আরও ছোট অবস্থায় যেগুলো মাটিতে পড়ে যায় সেগুলো আর বাঁচে না। খাবার নিয়ে এলে বাচ্চা পাখিগুলো মা কিংবা বাবা পাখির গলার ভেতর ঠোঁট ঢুকিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। প্রতিটি বাসাই যেন পাখিদের একেকটি পরিবার। যে পাখিরা কেবল উড়তে শিখছে, তারা একটু একটু করে এক ডাল থেকে আরেক ডালে যাচ্ছে।
পাখিদের ওপর নির্যাতনের অনেক খবরই আমরা পাই। সেসব আমাদের ব্যথিত করে। কিন্তু হাটে–বাজারে মানুষের পরম ভালোবাসায় পাখিদের নির্ভয় অবাস আমাদের ভীষণ রকম আশাবাদী করে তোলে, মানুষকে পাখির পরম বন্ধু ভাবতে শেখায়।