চালকের লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল নিবন্ধন দেওয়া হবে না—নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পরও চালকের লাইসেন্সের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষায় রাখছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজে লাইসেন্স সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়ে গ্রাহকদের ওপর লাইসেন্স থাকার বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
সড়ক পরিবহন আইনে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কোনো যানবাহনকে আলাদা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। শুধু রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে ট্যাক্সি ক্যাব ও সিএনজিচালিত অটোরকিশার জন্য আলাদা নীতিমালা আছে। এই নীতিমালায় এই দুটি যানের সংখ্যা নির্ধারিত আছে। বাকি যানগুলো ইচ্ছামতো নিবন্ধন নিতে পারেন মালিক। এর মধ্যে মোটরসাইকেল আলাদা করা কেন?
মানলাম, সাম্প্রতিক সময়ে মোটরসাইকেলের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়েছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত লাখের মতো। বর্তমানে তা পৌঁছেছে সাড়ে ৩৭ লাখে। অর্থাৎ গত এক যুগে মোটরসাইকেল বেড়েছে প্রায় ৩০ লাখ। বিশেষ করে ২০১৬ সাল থেকে ভাড়ায় চালিত (রাইড শেয়ারিং) মোটরসাইকেল চলতে দেওয়ার পর থেকে এই সংখ্যা লাফিয়ে বেড়েছে। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানিও বেড়েছে।
তবে এটাও সত্য, মোটরসাইকেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যক্তিগত গাড়িও। বিআরটিএর হিসাবে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে কার, জিপ ও যাত্রীবাহী পিকআপের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজারের মতো। এক যুগে এসব গাড়ির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ১৯ হাজারের মতো। অর্থাৎ সাড়ে তিন লাখের বেশি গাড়ি বেড়ে গেছে।
অত্যধিক মোটরসাইকেল মহাসড়কে চলার বিষয়টি সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়ির আধিক্য রাজধানীর মতো বড় শহরগুলোতে যানজট বাড়াচ্ছে—এটাও তো প্রমাণিত সত্য। তাহলে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নীতি কী? ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা বাস কেনার আগে তো চালকের লাইসেন্স দেখা হয় না। বরং গ্যাস–সংকটের কারণে যেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে, রান্নার চুলা জ্বলছে না অনেক জায়গায়, সেখানে ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাসে সস্তায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) সরবরাহ করা হচ্ছে কার স্বার্থে? এসব প্রশ্ন উঠেছে।
এবার আসা যাক মোটরসাইকেল প্রসঙ্গে। বিআরটিএ গত মঙ্গলবার মোটরসাইকেলের বিষয়ে একটি আদেশ জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেওয়ার সময় গ্রাহকের চালক লাইসেন্স থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে। লাইসেন্স না থাকলে নিবন্ধন দেওয়া হবে না।
মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের যানবাহনের চালকের লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্ব বিআরটিএর। সংস্থাটি গ্রাহকের কাছ থেকে ফির বিনিময়ে পরীক্ষা নেয়। এরপর বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তোলার পর চালককে স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স সরবরাহ করে। প্রায় চার বছর ধরে ১৫ লাখের মতো লাইসেন্স জমা আছে। এর মধ্যে কেউ কেউ তিন–চার বছর ধরে লাইসেন্সের অপেক্ষায়। অনেকে বিদেশে চালকের পদে কাজ করার জন্য ভিসা সংগ্রহ করে বসে আছেন। কিন্তু বিআরটিএ লাইসেন্স দিতে পারছে না।
একসময় চালকের স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্বে ছিল টাইগার আইটি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এই কাজ পেয়েছে ভারতের মাদ্রাজ প্রিন্টার্স। টাইগার আইটি প্রায় ৪৫ লাখ গ্রাহকের তথ্য যথাযথভাবে বিআরটিএকে বুঝিয়ে দিয়ে যায়নি বলে অভিযোগ আছে। যদিও এই তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা হয়েছে গ্রাহকের টাকায়। এর মালিকানা থাকার কথা বিআরটিএর। নতুন নিয়োগ পাওয়া মাদ্রাজ প্রিন্টার্সও পুরোনো ডেটা থেকে লাইসেন্স প্রিন্ট করতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। এ থেকেই মূলত সমস্যার সূত্রপাত।
বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলে থাকেন, টাইগার আইটি আজীবনের জন্য লাইসেন্স সরবরাহের কাজটি কবজায় নিতে চেয়েছিল। এ জন্যই তারা পুনরায় এই কাজ না পেয়ে ঠিকভাবে তথ্যভান্ডার বুঝিয়ে দিয়ে যায়নি। আর টাইগার আইটি যে প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স প্রিন্ট করেছে, মাদ্রাজ প্রিন্টার্স এসে পুরো ব্যবস্থা নিজেদের মতো করে সাজিয়েছে। নতুন করে মাদ্রাজ প্রিন্টার্স যে তথ্যভান্ডার তৈরি করছে, তা ভবিষ্যতে অন্য কেউ দায়িত্বে এলে একইভাবে উদ্ধার করতে পারবে না। অর্থাৎ টাইগার আইটি ও মাদ্রাজ প্রিন্টার্স দিনের পর দিন ভাগাভাগি করে কাজটি করার পথ তৈরি করেছে।
বর্তমানে নতুন কেউ চালকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলে মাদ্রাজ প্রিন্টার্স সরবরাহ করে। আর পুরোনো সাড়ে ১২ লাখ লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছে সেনাবাহিনীর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি। সহায়তা দিচ্ছে টাইগার আইটি। অল্প অল্প করে পুরোনো লাইসেন্স সরবরাহ করা হচ্ছে।
বিআরটিএ লাইসেন্স সরবরাহের বিষয়টি স্থায়ীভাবে সুরাহা করতে পারছে না চার বছর ধরে। দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের দ্বন্দ্বে উপকারভোগী বিআরটিএর কর্মকর্তারা। অথচ মাঝখানে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। বিআরটিএ নিজের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে না পারলেও মোটরসাইকেল চালকের ওপর খড়্গগ্রস্ত হতে পিছপা হয়নি।
মোটরসাইকেল যে শুধু ব্যক্তি নিজের প্রয়োজনে কেনে, সব সময় সেটা ঠিক নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য মোটরসাইকেল কিনে থাকে। বিশেষ করে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের বিপণন কর্মকর্তাদের মোটরসাইকেল দেয়। তাহলে প্রতিষ্ঠান মোটরসাইকেল কিনে কি কর্মীর নামে নিবন্ধন করবে? কর্মী যদি চাকরি ছেড়ে দেন, তাহলে মোটরসাইকেলের মালিকানা কার থাকবে? মোটরসাইকেলের বিমা কার নামে হবে? এসব জটিলতা কি ভেবে দেখেছে বিআরটিএ?
এ ছাড়া অনেক সময় বাবার টাকায় মোটরসাইকেল কিনে ছেলেরা ব্যবহার করে। এ ক্ষেত্রে কোন ছেলের নামে মোটরসাইকেল দেবেন বাবা?
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এর ফলে মোটরসাইকেলের শোরুমগুলো একধরনের দালালের আখড়ায় পরিণত হবে। কারণ, শোরুমগুলো লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার নামে রমরমা ব্যবসায় নামবে।
এই আলোচনার অর্থ এই নয় যে লাইসেন্স ছাড়া কেউ মোটরসাইকেল চালানোর সুযোগ পাক? আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে অযাচিত হয়রানির শিকার যেন মানুষ না হয়।
মোটরযান আইনে নিয়ম মানতে বাধ্য করা এবং না মানলে জরিমানা করার এখতিয়ার আছে একমাত্র পুলিশ ও বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের। কেনার আগে লাইসেন্স গছিয়ে না দিয়ে কেউ রাস্তায় যাতে লাইসেন্স ছাড়া না চালাতে পারে—সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিআরটিএর। এটাই হচ্ছে না দেশে।
এ ছাড়া বিআরটিএ যেনতেনভাবে পরীক্ষা নিয়ে লাইসেন্স দেয়, যানবাহন চালানোর যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন হয় না, সেই প্রশ্নও পুরোনো।
ঈদে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এটা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মানুষ কেন বাসে যাতায়াত না করে মোটরসাইকেলের মতো ঝুঁকিপূর্ণ যানে যাতায়াতকে বেছে নিচ্ছে? বড় কারণ, বাসে ভাড়ানৈরাজ্য এবং চাহিদামতো টিকিট না পাওয়া। সরকার প্রয়োজনীয় সংখ্যায় গণপরিবহন চালু এবং নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করতে পারছে না বলেই মোটরসাইকেলকে বেছে নিচ্ছে মানুষ। বাসমালিকদের লাভবান করতেই বিআরটিএ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আলোচনা উঠেছে।
এ কথা বলাই যায়, বিআরটিএ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নিজের কাজটা ঠিকঠাকভাবে না করে মানুষকে হয়রানির পথ করে দিচ্ছে।