‘বোনটারে কই যে বিয়ে দিছিলাম’

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্বামী মাহফুজ হাসান মিজানের সঙ্গে তাসমীন।
সংগৃহীত

তাসমীন আক্তার পড়াশোনা পড়তেন নরসিংদীতে, অনার্স তৃতীয় বর্ষে। তাঁর পড়ার বিষয় ছিল মনোবিজ্ঞান। তাসমীন বিয়ের পর সংসার করছেন দুই মাসেরও কম সময়। তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ হয়ে বাবার বাড়ি ফিরেছেন তাসমীন।


গত ২০ ফেব্রুয়ারি লাশ মর্গে রেখেই তাসমীনের বাবা মো. জালাল উদ্দিন কামরাঙ্গীরচর থানায় গিয়ে অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর মেয়েকে যৌতুকের জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেরে ফেলেছেন। তবে এ অভিযোগ থানা আমলে না নিয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে অপমৃত্যু মামলা করে (মামলা নম্বর ১২)। পরে তাসমীনের পরিবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪–এ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন সংশোধনী (২০০৩) আইনের ১১ (ক) / ৩০ ধারায় নালিশি মামলা করেছে।

তাসমীনের ভাই আল আমিন নরসিংদী থেকে ঢাকায় এসে এসে মামলার খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছেন। মামলার অভিযুক্ত আসামিরা কামরাঙ্গীরচরে দিব্যি ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছেন বলে এই ভাইয়ের অভিযোগ। আসামিপক্ষ আপসের জন্যও তাগাদা দিচ্ছে। আল আমিন বলেন, ‘ওদের যে পাঁচতলা বাড়ি আছে, তা লিইখ্যা দিলেও কোনো আপস করব না। আমার বোনটার হাতের মেহেদির রংও মুছে নাই, আর বোনের স্বামী ফোন ধরে বলেও নাই, আপনেরা আসেন। যে বোন কলেজে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেছে, লিখেছে, সেই বোনটা নাকি আত্মহত্যা করছে। কন, এই কথা কেমনে বিশ্বাস করি। বোনটারে কই যে বিয়ে দিছিলাম!’

গত বুধবার আল আমিন কথাগুলো বলেন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে। মুঠোফোনে একটু পরপর বোনের ছবি দেখছিলেন। আক্ষেপ যেন শেষই হচ্ছিল না, বিয়ের আগে আর একটু যদি খবর নিতে পারতেন, তাহলে এই জায়গায় বোনের বিয়ে দিতেন না। বোনটা পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। বিয়েতে ছেলেপক্ষের নানা আবদার মেটাতে লাখ লাখ টাকাও খরচ করেছেন। আর যা যা লাগবে বলে বলেছিল, বোনের সুখের জন্য তাও দিতে রাজি হয়েছিলেন।

তাসমীনের ব্যবহৃত খাতার একটি পৃষ্ঠা দেখালেন আল আমিন। মুঠোফোনের ছবি অনুযায়ী, সাদা পৃষ্ঠায় কোনো এক সময় তাসমীন পেনসিল দিয়ে একটি মেয়ের ছবি এঁকেছেন। পাশেই গলায় ফাঁস দেওয়ার ছবিটি লাল দাগ দিয়ে কাটা। আর নিচে যা লিখেছেন, তার মূল কথা হলো আত্মহত্যা করার পেছনে হয়তো দু-একটা কারণ আছে। তবে বেঁচে থাকার পেছনে আছে হাজারো কারণ। তাই জীবন থেকে দু-একটা কারণকে বিদায় বা শেষ করে দিতে হবে। আর বেঁচে থাকার কারণগুলোকে সঙ্গী করে নিলে বেঁচে থাকাটা আরও সুন্দর হয়ে যাবে।

আত্মহত্যা কেন করা উচিত নয়, তাই লিখেছেন তাসনীম

কামরাঙ্গীরচরের খলিফাঘাটের ৮২০ চাঁদ মসজিদ রোডের মাহফুজ হাসান মিজানের সঙ্গে তাসমীনের বিয়ে হয় গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর। আর তাসমীন মারা যান চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি।

আল আমিন যেন চোখের সামনে পুরো ঘটনা দেখতে পাচ্ছিলেন। বলেন, ছেলেপক্ষ বাড়ি গিয়ে মেয়েকে পছন্দ করে। তারপর ছেলেকে দেখেও পছন্দ হয়। ছেলে সৌদি আরবে ছিলেন, হজ করে দেশে ফিরেছেন, পাঁচতলা বাড়ি আছে, কাপড়ের ব্যবসা করেন। সব মিলে ছেলে খারাপ না। কথাবার্তাতেও কিছু বোঝার উপায় নেই। তবে ছেলেপক্ষ বিয়ের জন্য খুব তাড়া দিতে থাকে। বিয়ের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তখন আর ছেলের বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হয়নি।

আল আমিন বারবার বলছিলেন, ‘আহা, আরেকটু যদি খবর নিতে পারতাম, তাহলে বোনকে এই জায়গায় বিয়ে দিতাম না। বিয়ের পর প্রথম কয় দিন ভালোই ছিল। তবে আমার বোনকে আমাদের বাড়িতে যাইতে দিতে চাইত না। একবার জামাই মোটরবাইকে করে নিয়ে যায়, গিয়ে আমার বাবার কাছ থেকে যাতায়াতের ভাড়াও আদায় করে। আমাদের একটু একটু করে খটকা লাগতে থাকে।’

আল আমিন বলেন, ‘বিয়ের আগে শুনছি ছেলে সৌদি আরবে ছিল। ফেরার সময় হজ করে ফিরেছে। তবে পরে জানতে পারি, ছেলে সৌদি আরবে গিয়ে জেল খাটে। নিজের কাপড়ের ব্যবসা আছে বলে প্রচার করলেও আসলে তা ছেলের ভাইয়ের ব্যবসা। বিয়ের পর জানতে পারি, ছেলে নেশা করে। ছেলের বাবা নেশা ছাড়ানোর জন্য পুলিশকে দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। দেশেও বিভিন্ন সন্ত্রাসীকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল।’

আল আমিন আরও বলেন, ‘বোনটার হাতের মেহেদিই তো মুছে নাই। বোনটার লাশ কেমন দেখব? মর্গে আসার পর মিজানের পরিবার জানায়, আমার বোন নাকি ফ্যানে কাপড় লাগিয়ে ফাঁসি দিছে। কিন্তু চারতলার যে ঘরের কথা বলে, সেই ঘরের কিছু কাজ চলছিল। সেই ঘরে কেউ থাকত না। কোনো আসবাবপত্রও ছিল না। ফ্যানের হুক থাকলেও সেই ঘরে ফ্যানও ছিল না। তাইলে আমার বোনটা ফাঁসি দিল কেমনে? পুলিশ বাড়ি থেকে লাশ উদ্ধার করে নাই। আর পুলিশও বলছে, আমার বোন নাকি আত্মহত্যাই করছে। তাই আমার বাবার অভিযোগ আমলেই নেয় নাই।’

তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তাসমীন ছিলেন সবার বড়। তাসমীনের বিয়ে ছিল পরিবারের প্রথম বিয়ে। তাই সাধ্য অনুযায়ী বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়েছে। তাসমীনের বাবা ও ভাই আল আমিন ‘মামুন টেলিকম’ নামের একটি দোকান চালান।
তাসমীনের স্বামী মিজানের মুঠোফোনটি বন্ধ করে রাখা। তবে কামরাঙ্গীরচর থানার অপমৃত্যু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই জহিরুল ইসলাম জানান, মামলার ‘মেরিট’ অনুযায়ী আদালতে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। আর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা লাশ বাসা থেকে উদ্ধার করিনি। তবে লাশের গলায় অর্ধবৃত্তাকার দাগ ছিল। এলাকাটাও আত্মহত্যাপ্রবণ। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যুর কথা উল্লেখ আছে। আমরা আদালতে সেভাবেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’

অন্যদিকে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা পিটিশন মামলার তদারককারী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যৌতুকের জন্য হত্যার অভিযোগে কামরাঙ্গীরচর থানা মামলা নেয়নি বলেই আদালতে নালিশি মামলা (মামলা নম্বর ৬৪) করা হয়েছে। আদালত ঘটনার সত্যতা জানার জন্য থানাকে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।’