নির্দিষ্ট কোনো পদে চাকরির জন্য আবেদন না করে এবং জীবনবৃত্তান্ত ও পরীক্ষা না দিয়ে সরকারি ব্যাংকে চাকরি পাওয়া কি সম্ভব? কারও কাছে বিষয়টি অসম্ভব মনে হলেও বহুল আলোচিত রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকে নিয়োগে এমনটা ঘটেছে। এই ব্যাংকে নিয়োগ-পদোন্নতিতে বিচিত্র ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। অনেকের নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়স কোনো বাধা হয়নি। কেউ কেউ ভুয়া সনদ জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। আবার কেউ জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পর।
নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম-দুর্নীতির এসব ঘটনা ঘটেছে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। তাঁর সময়েই নিয়োগ ও পদোন্নতিতে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, যা বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের অধীন বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের বিশেষ নিরীক্ষায় উঠে এসেছে।
ব্যাংকের ৭২৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে আপত্তি দিয়েছে অডিট অধিদপ্তর। সদ্য বিদায়ী বছরের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব কমিটিতে দেওয়া ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের হিসাব নিরীক্ষাকালে ব্যাংকের নিয়োগসংক্রান্ত নথি ও ব্যক্তিগত নথি পর্যালোচনা করে এসব অনিয়ম পাওয়া গেছে।
ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাইয়ের বাড়ি বাগেরহাট জেলায়। তিনি চেয়ারম্যান থাকার সময় এই জেলা থেকে ব্যাংকটিতে চাকরি পেয়েছেন ২৪২ জন।
সরকারি খাতের ভালো ব্যাংক হিসেবে একসময় পরিচিত ছিল বেসিক ব্যাংক। এই ব্যাংকে লুটপাট শুরু হয় আবদুল হাই চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। ব্যাংকটির ঋণ কেলেঙ্কারি ও অনিয়ম নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে। তবে মামলায় আবদুল হাইকে আসামি করা হয়নি।
আবদুল হাই ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বাগেরহাট-১ আসন (চিতলমারী, মোল্লাহাট ও ফকিরহাট) থেকে জাতীয় পার্টির সাংসদ হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া দেয়। বর্তমান সরকারের ওপর মহলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত।
অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংকে চাকরির জন্য আবু শহীদ আবেদন করেছিলেন ২০১২ সালের মে মাসে। তাঁর আবেদনপত্রে কোনো পদের নাম উল্লেখ ছিল না। তিনি ‘সুইটেবল’ পদে তাঁকে নিয়োগ দেওয়ার আবেদন করেন। ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ তাঁকে ব্যবস্থাপক পদের জন্য উপযুক্ত মনে করে এবং পরের মাসে তাঁর নিয়োগপত্র ইস্যু করে। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪২ বছর। অথচ ব্যাংকের নিয়োগবিধি অনুযায়ী, ওই পদে নিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ৪০ বছর।
আবদুল গফুর বিদেশে রেস্টুরেন্টে কর্মরত ছিলেন। তিনি কখনো ব্যাংকে চাকরি করেননি। ৫২ বছর বয়সে তিনি বেসিক ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ পান। এ জন্য তাঁকে কোনো পরীক্ষা দিতে হয়নি। আবদুল গফুর ২০১৯ সালে চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। ব্যাংকটির নিজস্ব নিয়োগবিধি ২০০৭ অনুযায়ী, সহকারী মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৪২ বছর এবং ব্যাংকিং খাতে ১২ বছরের পূর্ব অভিজ্ঞতা প্রয়োজন।
২০১১ সালে জাহাঙ্গীর কবিরকে সহকারী মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৩ বছর। এর আগে তাঁর ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তিনি বেসিক ব্যাংকে চাকরির জন্য কোনো আবেদনও করেননি। তিনি ২০১৬ সালে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন।
ব্যাংকটিতে নিয়োগ-পদোন্নতিতে যেসব আপত্তি পাওয়া গেছে, সে সম্পর্কে ব্যাংকটির কাছে প্রথমে জবাব চেয়েছিল অডিট অধিদপ্তর। কিন্তু জবাব না পেয়ে ২০১৫ সালে বেসিক ব্যাংককে তাগিদপত্র দিয়েছিল অডিট অধিদপ্তর। আর বেসিক ব্যাংক জবাব দিয়েছে ২০২১ সালের জুনে। কিন্তু জবাবগুলো সন্তোষজনক ছিল না। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ-পদোন্নতি দেওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার দায়দায়িত্ব নির্ধারণসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিয়োগকারী অথবা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর কাছ থেকে বেতন-ভাতা বাবদ পরিশোধ করা অর্থ আদায় করা এবং নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করেছে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়।
এ ছাড়া সংসদীয় কমিটি নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সে সঙ্গে এই অনিয়মের সঙ্গে যাঁরা জড়িত এবং যাঁরা অনিয়মের মাধ্যমে চাকরি ও পদোন্নতি পেয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন সংসদের সরকারি হিসাব কমিটির একাধিক সদস্য। এসব অভিযোগ আরও খতিয়ে দেখতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে কমিটি।
সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি রুস্তম আলী ফরাজী গতকাল রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বেসিক ব্যাংকে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে। অনেকের যোগ্যতা ছিল না, বয়স বেশি ছিল। পদোন্নতিতেও অনিয়ম হয়েছে। যদি কোনো যোগ্যতা না থাকে, তাহলে সেখানে মানবিকতা দেখানোর সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আপত্তিতে অনেক ক্ষেত্রে ‘গ্রসলি’ বলা হয়েছে। সংসদীয় কমিটি এই অনিয়মগুলো আরও খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি করে দিয়েছে। এই কমিটি অভিযুক্ত প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয় আলাদাভাবে খতিয়ে দেখবে। কমিটিকে দুই মাসের সময় দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন পেলে তার ভিত্তিতে সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে সবার প্রতি সম–অধিকার নিশ্চিত থাকলেও ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়োগ নীতিমালা লঙ্ঘন করে ৪৯৮ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছে। শিক্ষাজীবনে এক বা একাধিক তৃতীয় শ্রেণি পাওয়া ব্যক্তিকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিছু কর্মকর্তার ব্যক্তিগত নথিতে সংযুক্ত ঘরোয়া পরীক্ষার খাতায় রোল নম্বর, পরীক্ষার কেন্দ্রের নাম, পরীক্ষার তারিখ উল্লেখ নেই। এমনকি পরীক্ষার খাতায় পরিদর্শক এবং খাতা মূল্যায়নকারীর সই ও তারিখ নেই। ফলে প্রমাণিত হয়, ভুয়া পরীক্ষা দেখিয়ে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রার্থীর আবেদনপত্রে পূর্ণাঙ্গ জীবনবৃত্তান্ত ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনেক প্রার্থী কোনো পদের জন্য আবেদন করেননি। অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থীকে নিয়োগপত্র দেওয়ার অনেক পরে আবেদন বা জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়া হয়েছে। জীবনবৃত্তান্ত দেওয়ার আগেই নিয়োগপত্র দেওয়ায় প্রমাণিত হয় যে ব্যাংকের নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ও সম্পূর্ণ জালিয়াতির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাঁদের মধ্যে ২৪৮ জন ঢাকা জেলার এবং ২৪২ জন বাগেরহাট জেলার।
নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, ২৯ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চাকরির কোনো বিজ্ঞাপন না দিয়েই। তাঁদের ভুয়া পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। কারণ, তাঁদের পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষকের ও পরিদর্শকের সই ও তারিখ নেই। তাঁরা চাকরির জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পদে আবেদন করেননি। ৭ জন কর্মকর্তা শিক্ষাগত যোগ্যতার যে সনদ জমা দিয়েছেন, তা ভুয়া। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁদের বয়স নিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ বয়সসীমার চেয়ে বেশি।
ব্যাংকের কৃতিত্বপূর্ণ ও দুঃসাধ্য কাজ সম্পাদন বা ব্যাংকের কোনো অসাধারণ কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হলে সে ক্ষেত্রে ‘এক্সিলারেটেড প্রমোশন’ দেওয়া যায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এমন ৩০ জনকে এ ক্ষেত্রে পদোন্নতি দিয়েছে, যাঁদের কৃতিত্বপূর্ণ কাজের নজির নেই। নিরীক্ষায় এসব কর্মকর্তাকে এক্সিলারেটেড প্রমোশন দেওয়ার পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনাগুলো ঘটেছিল বেসিক ব্যাংকের সমালোচিত চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর সময়ে। গতকাল তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগ-পদোন্নতিতে অডিট আপত্তিগুলোর বিষয়ে সরকারি হিসাব কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবে, তাঁরা সেটা করবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি হিসাব কমিটির বৈঠকে একাধিক সদস্য বেসিক ব্যাংকে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত এবং অনিয়মের মাধ্যমে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মত দেন। তাঁরা বলেছেন, এখানে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থাও যদি না নেওয়া হয়, তাহলে তা একটি খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অডিটে যেটা ধরা পড়েছে, তাতে দেখা যায় বেসিক ব্যাংকে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে বড় ধরনের জালিয়াতি ও দুর্নীতি হয়েছে। শুধু কিছু কর্মকর্তা এত বড় অনিয়মে জড়িত, তা নয়। উচ্চপর্যায়ের যোগসাজশ ছাড়া এমন হওয়া সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক লেনদেন ছিল কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের উচিত হবে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া।