>• গত ২৭ বছরে দেশে মোট ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়
• ২০০১ থেকে রাজনৈতিক যোগসূত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাপ্তির প্রবণতা
• বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বড় অংশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আছে
• আরও শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আবেদন জমা পড়ে আছে
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় অর্ধেকই অনুমোদন পেয়েছে গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে। আর সেগুলোর অর্ধেকের মালিকানা ও পরিচালনায় আছেন শাসক দল বা জোটের মন্ত্রী-সাংসদ-নেতা এবং সরকার-সমর্থক ছাত্র ও শিক্ষকনেতারা। তাঁরা কেউ এখনো পদাসীন, কেউবা সাবেক।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদেরও অনেকের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের যোগাযোগ আছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে বেসরকারি সংস্থা বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। মালিক তথা ট্রাস্টিদের পর্ষদে পরিবারের সদস্যদের ভিড় একটি সাধারণ প্রবণতা। পরিচালনার কাজেও আত্মীয়দের প্রাধান্য নজরে পড়ে।
গত ২৭ বছরে দেশে মোট ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়। তার একটি অবশ্য বন্ধ হয়ে গেছে। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত আসন না থাকার যুক্তিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। অনুমোদন শুরু হয় ১৯৯২ সালে। ২০০১ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রথম ৯ বছরে ২১টি বিশ্ববিদ্যালয় আসে।
প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, রাজনৈতিক যোগাযোগে বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে, বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকে। তখন ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত হয়। সেগুলোর প্রায় এক-চতুর্থাংশের (৮) মালিকানায় ছিলেন ক্ষমতাসীন দলগুলোর নেতা-মন্ত্রী অথবা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। সরকারের শেষ দুই কর্মদিবসে দুটির অনুমোদন হয়েছিল। একটির উদ্যোক্তা ছিলেন তখনকার মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, অন্যটি পেয়েছিল বেসরকারি সংস্থা আশা।
এরপর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল টপকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেওয়ার হিড়িক শুরু হয় ২০১২ সালে। তখন থেকে চলতি বছর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের তিন আমলে আরও ৫০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সূত্রমতে, অন্তত ২৫টির মালিকেরা সরাসরি ক্ষমতাসীন দল অথবা এর সমর্থক ছাত্র-শিক্ষক সংগঠনের নেতা। এগুলোর ১৬টির মালিকানায় আছেন বর্তমান বা সাবেক সাংসদ, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী আর উপমন্ত্রী।
২০১৪ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি গবেষণা করেছিল। তখন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ছিলেন ব্যবসায়ী। সমান হিস্যা ছিল শিক্ষাবিদদের। আর প্রায় এক-পঞ্চমাংশের উদ্যোক্তা ছিলেন রাজনীতিবিদ বা রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাদবাকিদের মধ্যে ছিলেন চিকিৎসক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বা এনজিও উদ্যোক্তারা।
ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন টিআইবির সাবেক কর্মকর্তা নীনা শামসুন নাহার। তিনি ৯ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ী আর শিক্ষাবিদ মালিকদেরও রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল। গবেষণায় দেখা যায়, মালিকেরা ‘অলাভজনক’ এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নানাভাবে সুবিধা নেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বড় অংশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নিয়মকানুন না মানা, নিয়মিত বার্ষিক হিসাব নিরীক্ষা প্রতিবেদন না দেওয়া, শিক্ষার নিচু মান অথবা যথেচ্ছ ফি আদায়ের অভিযোগ আছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত ও পরিচালনার প্রথম আইনটি হয়েছিল ১৯৯২ সালে। সেটা রহিত করে নতুন আইন হয়েছে ২০১০ সালে। দেখভালের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)। আইনটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি (মালিক) পর্ষদের সদস্য হওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো যোগ্যতার কথা বলা নেই।
ইউজিসির শীর্ষ পর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পারেন। রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী মালিকদের নিয়মনীতি মানানো অনেক সময় কঠিন হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ঝুঁকিতে পড়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভালের দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আরও শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আবেদন জমা পড়ে আছে। এগুলোরও অধিকাংশের পেছনে আছেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতা এবং ব্যবসায়ীরা।
মন্ত্রী-সাংসদ ও নেতাদের বিশ্ববিদ্যালয়
গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির ঠাঁই বরিশাল নগরের নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া একটি ভাড়া বাড়ি। চারটি অনুষদে শিক্ষার্থী প্রায় ১ হাজার ৩০০। প্রায় সাড়ে তিন বছরেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ হয়নি। পূর্ণাঙ্গ ল্যাবরেটরি বা গ্রন্থাগার গড়ে ওঠেনি। রেজিস্ট্রার এ কে এম এনায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। ক্যাম্পাসের জন্য জমি কেনা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি পর্ষদের চেয়ারম্যান সৈয়দা আরজুমান বানু। তিনি সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকের স্ত্রী। পর্ষদের সচিব নানক, ট্রাস্টে আরও আছেন তাঁর মেয়ে এবং পূত্রবধু।
গত মার্চে অনুমোদন পেয়েছে ‘ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া’। সদর উপজেলার চিনাইরে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। গত বছর অনুমোদন পাওয়া বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং।
২০১২ সালেই অনুমোদন পেয়েছে ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রামে হয়েছে পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইট বলছে, এর ট্রাস্টি পর্ষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক। তিনি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতিও।
সে বছর ঢাকায় অনুমোদন পায় ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। এর চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। চুয়াডাঙ্গায় হয় ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাংসদ সোলেয়মান হক জোয়ার্দার।
ঢাকার সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তাদের একজন সাবেক বিমান ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। আরও আছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাংসদ নজরুল ইসলাম ওরফে বাবু। পর্ষদের চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থিত এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি মূলত ওই ব্যাংকের মালিকদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। বিশ্ববিদ্যালয়টির ভাইস চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাংসদ আবদুল মান্নান। খুলনার নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান খুলনার বর্তমান মেয়র ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তালুকদার আবদুল খালেক।
২০১২ সালে অনুমোদিত ফেনী ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি পর্ষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। পরে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়ে একসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইট অনুযায়ী ফেনীতে আওয়ামী লীগের সাংসদ নিজামউদ্দিন হাজারীও এ পর্ষদে আছেন।
কুষ্টিয়ার রবীন্দ্র মৈত্রী ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদের সভাপতি সাংসদ হাসানুল হক ইনু। তাঁর স্ত্রী আফরোজা হকও ট্রাস্টি পর্ষদে আছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু কুমিল্লার সিসিএন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান।
জামালপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাংসদ মির্জা আজমের উদ্যোগের স্বীকৃতি আছে। লক্ষ্মীপুরের ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ আনোয়ার হোসেন খান রাজধানীর উত্তরায় অনুমোদন পাওয়া আনোয়ারা মডার্ন ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান।
সিলেটের নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ চৌধুরী। তিনি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন আহমেদ।
ঢাকার ফারইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা সোনার বাংলা ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন। তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রধান উপদেষ্টা। বর্তমানে তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিকদের সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি। বরিশালের ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের ট্রাস্টি পর্ষদে আছেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজিত রায় নন্দী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শওকত হোসেন খান।
পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আছেন ছাত্রলীগের চার সাবেক নেতা। দুজন সাবেক সভাপতি এ কে এম এনামুল হক এবং এইচ এম বদিউজ্জামান। অন্য দুজন সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাংসদ সাইফুজ্জামান ওরফে শিখর (ভারপ্রাপ্ত) ও মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী।
২০১৫ সালে অনুমোদন পাওয়া মানিকগঞ্জের এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অন্যতম উদ্যোক্তা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান। রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি পর্ষদের সঙ্গে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার যুক্ততার কথা শোনা যায়।
পরিবারের মধ্যেই
অন্তত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পরিবারের সদস্যরা ট্রাস্টিদের পর্ষদেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন, আবার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ বা রেজিস্ট্রারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও আছেন। তাঁরা সবাই সরকার-সমর্থক।
রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদা খালেক। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য তাঁর স্বামী আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আবদুল খালেক। তাঁদের মেয়ে ট্রাস্টি পর্ষদের সদস্য। আর জামাতা রিয়াজ মোহাম্মদ একাধারে রেজিস্ট্রার ও ট্রাস্টি। অধ্যাপক খালেক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য।
রাজশাহী শহরে একটি ভবনের বড় দুটি তলা ভাড়া করে বিশ্ববিদ্যালয়টি চলছে। ভবনটিতে ব্যাংক, কোচিং সেন্টারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে। রিয়াজ মোহাম্মদ বলেছেন, নিজস্ব ক্যাম্পাসের জন্য জমি কিনেছেন।
শরীয়তপুরের জেড এইচ শিকদার ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ–সমর্থক ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। ভাইস চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা শিকদার। ট্রাস্টি পর্ষদে আছেন তাঁদের মেয়ে ক্ষমতাসীন দলের সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ পারভীন হক। পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্যও আছেন।
রাজধানীর ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী এর উপাচার্য। তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা। তাঁর স্ত্রী মোর্শেদা চৌধুরী কোষাধ্যক্ষ। আর ছেলে মুশফিক মান্নান চৌধুরী ট্রাস্টি বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এ ছাড়া ঢাকার উত্তরা ইউনিভার্সিটির শীর্ষপদে আছেন একই পরিবারের সদস্যরা।
শিক্ষকনেতা ও অন্যান্য
২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া নাটোরের রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্যোক্তা অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন এবং আওয়ামী লীগ-সমর্থক নীল দলের সাবেক আহ্বায়ক। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে।
২০১২ সালে অনুমোদিত কিশোরগঞ্জের ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্যোক্তা আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য দুর্গাদাস ভট্টাচার্য।
গাজীপুরে অবস্থিত জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ট্রাস্টি পর্ষদে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নীল’ শিক্ষকদের সাবেক নেতা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মেসবাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নবগঠিত অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলেরও চেয়ারম্যান।
ঢাকার নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকপক্ষ খুলনায় নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছেন। এটির উপাচার্য আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ। গত নির্বাচনে তিনি সাতক্ষীরা–৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে খুলনার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অনুমোদন পেয়েছে রূপায়ণ এ কে এম শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়। সাংসদ এ কে এম শামীম ওসমানের বাবার নামে বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম। ব্যবসায়ী গোষ্ঠী রূপায়ণ এর উদ্যোক্তা। ফরিদপুরের টাইমস ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তা সরকার–সমর্থক সাবেক ব্যবসায়ী নেতা শরীফ এম আফজাল হোসেন।
প্রধান উদ্যোক্তার সরাসরি রাজনৈতিক যোগসূত্র নেই, এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট সংখ্যা অন্তত ৩৮। এগুলোর মধ্যে গত ১০ বছরে হয়েছে ১৯টি। এই উদ্যোক্তাদের বড় অংশ ব্যবসায়ী। তিনটি হচ্ছে সেনাবাহিনীর। কয়েকটির উদ্যোক্তা বিভিন্ন এনজিও বা সংগঠন। এগুলোর মধ্যে আছে পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, ঢাকা আহছানিয়া মিশন, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি, নটর ডেম কলেজ ও কুমুদিনী ট্রাস্ট।
মালিকানার রং পাল্টানো
অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি অনুমোদন পেয়েছিল ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের স্ত্রী অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহ-উপাচার্য ও পরে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আবুল হোসেন শিকদারের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আনোয়ারাকে হটিয়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন সাবেক নেতাকে ট্রাস্টি পর্ষদে নেওয়া হয়।
তখন মামলা-মোকদ্দমা বাধে। ইউজিসির উদ্যোগে বিরোধ মেটে। আনোয়ারা বেগম পদ ফিরে পান। তিনি মারা গেলে ট্রাস্টি পর্ষদের চেয়ারম্যান হন ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ইসরাফিল আলম। বোর্ডে আছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের চার সাবেক নেতা। তাঁরা হচ্ছেন ছাত্রলীগের সর্ব-সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শরীয়তপুরের সাংসদ ইকবাল হোসেন, সভাপতি লিয়াকত শিকদার, সহসভাপতি গোলাম সারোয়ার কবির এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়াউর রহমান হল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মো. হেমায়েত হোসেন।
ক্ষমতা পাল্টালে মালিকানার পালাবদল ঘটেছে আরও দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের মতে, রাজনৈতিক যোগাযোগে অনুমোদন পাওয়া নয়, মূল উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে চলছে, সেটা।
জিল্লুর বলেন, অনুমোদন পাওয়ার জন্য উদ্যোক্তারা যতটা আগ্রহী, শিক্ষার মানোন্নয়নে অনেকেই ততটা আগ্রহ দেখান না। রাজনৈতিক যোগসাজশে বিশ্ববিদ্যালয় পেয়ে সেটার মান খুব ভালো করলে কিন্তু আপত্তি ওঠে না। সুতরাং শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে পারবে, এমন উদ্যোগকেই অনুমোদন দেওয়া উচিত।
আগামী পর্ব: বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম নিয়ে