বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে পৃথিবীর সবাই চেনে। যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ ডলারের কাগজের মুদ্রায় যে তাঁর ছবি দেখা যায়। তাঁর জীবন, তাঁর বেড়ে ওঠা, তাঁর কর্মজীবন, তাঁর রাজনৈতিক জীবন, তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানা বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এখনো পড়াশোনা ও গবেষণা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে জন্ম নেওয়া একজন তরুণ কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফাউন্ডিং ফাদার’দের একজন হয়ে উঠলেন, তা নিয়ে সবার আগ্রহ আছে। জর্জ ওয়াশিংটন যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, তেমনি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ইউরোপে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন।
বেনঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নামটি যুক্তরাষ্ট্রে এতটাই জনপ্রিয় যে পরবর্তী সময়ে দুজন মার্কিন রাষ্ট্রপতির নাম তাঁর অনুসরণে ছিল—ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ও ফ্রাঙ্কলিন পিয়ার্স।
আমরা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে বাংলাদেশে চিনি বিজ্ঞানী হিসেবে! যুক্তরাষ্ট্রের স্রষ্টাদের একজন হিসেবে যত না চিনি, তার চেয়ে বেশি চিনি অন্য রকম একটা গল্পের মাধ্যমে। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বজ্রপাত নিয়ে কাজ করেছিলেন। ঘুড়ি উড়িয়ে সুতা দিয়ে তিনি বজ্রপাত যে বিদ্যুৎ তা প্রমাণ করেন। সেই যে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন, সেটা আমাদের এখানে খুব জনপ্রিয় একটা লোকগাথা হিসেবে আছে বলা যায়। সেই পাগলামির জন্য পরবর্তী সময়ে উঁচু ভবন রক্ষায় লাইটেনিং রড তৈরি করে ৪৬ বছর বয়সে পৃথিবীর ইতিহাসে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তাঁর জায়গা করে নেন।
সবাইকে নিয়ে এগিয়ে আসা
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের বেড়ে ওঠা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তিনি প্রচণ্ড মাত্রায় সামাজিক একজন মানুষ ছিলেন। তিনি খুবই হতদরিদ্র অবস্থায় ফিলাডেলফিয়ায় আসেন এবং ধীরে ধীরে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি তৈরি করেন। প্রথমে তিনি একটি ছাপখানায় কাজ নেন। পরবর্তী সময়ে ছাপাখানার মালিক হন। একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিটিশ শাসন চলছিল ও ব্রিটিশ পোস্ট অফিসে কাজের জন্য তাঁর পত্রিকা অনেক মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ পান। ব্রিটিশ শাসকেরা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে পছন্দ করতেন। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
লেখা যখন শক্তি
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন লেখক হিসেবেও বেশ বিখ্যাত ছিলেন। তার চরিত্রগঠনের ১৩টি গুণ নিয়ে লেখার কথা সবাই জানে। পুওর রিচার্ডস অ্যালামনাক সিরিজ প্রকাশের জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। বেঞ্জামিন ছদ্মনামে অনেক লেখা লিখেছেন। এমনকি তাঁর ভাইয়ের পত্রিকাতেও তিনি ছদ্মনামে লিখতেন। প্রচুর বই পড়তেন তিনি। মানুষকে অনেক চিঠি লিখতেন তিনি। লেখালেখির মাধ্যমে তিনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ৮০ বছরের জীবনে অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলা যায়। প্রথমে পত্রিকার প্রকাশক-সম্পাদক, তিনি একাধারে পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সমাজ সংস্কারক হিসেবে তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।
ফ্রাঙ্কলিন থেকে যা শিখতে পারি
বেঞ্জামিন সব সময়ই আলোচনার মাধ্যমে, পরামর্শের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতেন। যেকোনো সমস্যায় তিনি আলোচনার টেবিলকে সব সময় গুরুত্ব দিতেন। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রচণ্ডমাত্রায় জ্ঞানপিপাসু ছিলেন বলা যায়। নিজে বই পড়তেন, গবেষণা করতেন। তাঁর ভাষ্যে, জ্ঞান অর্জনের জন্য যেকোনো বিনিয়োগই লাভবান।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ৪২ বছর বয়সে নিজের কাজের থেকে অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার পরে তিনি রাজনীতি শুরু করেন। নিজেকে তৈরির জন্য বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রতি সপ্তাহে একটি করে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেন। ধীরে ধীরে নিজেকে সেভাবে তৈরি করতেন। কী করছেন, কী না করছেন—এসব বিষয়ে বেঞ্জামিন গভীরভাবে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতেন। বলা হয়ে থাকে, বেঞ্জামিন নিজেই নিজেকে তৈরি করেছেন।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন মানুষের উপকার করতেন। তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে ফিলাডেলফিয়ার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি, আমেরিকার নন-রিলেজিয়াস কলেজ ও ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট তৈরি করেন। ভীষণ রকমের আড্ডাপ্রিয় ছিলেন তিনি। ফিলাডেলফিয়ায় ক্লাব করেছেন, প্যারিসের ক্লাবগুলোতে তিনি ছিলেন পরিচিত মুখ।
মস্তিষ্কের শক্তির ওপর নির্ভরতা ছিল বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের। প্রতিদিন সকাল শুরু করতেন মেডিটেশন কিংবা জার্নালিং করার মাধ্যমে। এতে তিনি নিজের সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে সংযুক্ত থাকতেন। নিজেকে জ্ঞানপিপাসু ভাবার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতাবোধ চর্চা ও নিজেকে নিয়ে সব সময় গুরুত্ব দিতেন। তিনি যা করতেন সবকিছু পরিকল্পনা করার মাধ্যমে তৈরি করতেন। আজীবন শিখে গেছেন সব। বেঞ্জামিন বিশ্বাস করতেন যেকোনো রুটিন কিংবা ডিসিপ্লিন সবকিছুকে আরও সহজ করে তুলতে পারে।
নিজেকে গভীরভাবে অবলোকনের মাধ্যমে বারবার নিজের ভুলগুলো খুঁজে বের করে নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জীবন থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষা বলে মনে হয়েছে আমার। আমরা যদি নিজেকে তৈরি করতে চাই। তাহলে নিজেকে নিয়ে ফোকাস থাকতে হবে। প্রতিদিন নিয়ম মেনে কাজের চেষ্টা করতে হবে। প্রযুক্তি বা মনে রাখার ওপর নির্ভর না করে কাগজে কলমে হিসাব-নিকাশ করে নিজেকে বদলাতে হবে।
বেঞ্জামিন অনেক শব্দ কখনই মুখে আনতেন না। নিজের ভাষাবোধের ওপর তাঁর ভীষণ রকমের নিয়ন্ত্রণ ছিল। নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর। নিজেকে আমাদের সংশোধন করতে চাইলে, আমাদের নিজের ভুলগুলো জানতে হবে। তা সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে।
অহংকারবোধ যেকোনো যুদ্ধকে আরও কঠিন করে ফেলে। তখন নিজের সঙ্গেও যুদ্ধে নামতে হয়। কোনোভাবেই নিজের জন্য বেশি ভাবা যাবে না। অন্যের জন্য কী করা যায়, অভাবে অন্যকে সহায়তা করা যায় তা নিয়ে সময় দিতে হবে।
বেনঞ্জামিন বিশ্বাস করতেন, আমরা যেকোনো কিছুই পরিশ্রম, ফোকাস ও আগ্রহী দিয়ে জয় করতে পারি। বেনঞ্জামিন মনে করতেন, দাবা খেলার কৌশল আমাদের মস্তিস্ককে শাণিত করে।
প্রতিদিন সকালে বেনঞ্জামিন মনে করতেন, নিজেকে প্রশ্ন করতেন, ‘আজ সারা দিন আমি কোন ভালো কাজটা করব?’ আর দিনের শেষে তাঁর জিজ্ঞাসা থাকতো, ‘আজ সারা দিন আমি কোনো ভালো কাজটি করেছি?'
দিনের শুরুতে নিজের প্রতিষ্ঠান বা দোকানের সামনের জায়গা পরিষ্কার করতেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। তাঁর ভাষ্য ছিল, ধীরে ধীরে নিজেকে এগিয়ে নিতে হয় ছোট ছোট কাজ করে।
বেনঞ্জামিন বিশ্বাস করতেন, কোনোভাবেই কখনোই নিজের কাজের পেছনে জাস্টিফিকেশন তৈরি করা যাবে না। কাজে ফোকাস বাড়াতে হবে।
বেনঞ্জামিনকে নিয়ে আরও যা জানা যায়
-বেঞ্জামিনের কারণেই ব্রিটিশরা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে স্ট্যাম্প আইন সরিয়ে নেয়।
-বেঞ্জামিন আমেরিকান ছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতার পর তাঁর ছেলে উইলিয়াম ব্রিটেন চলে যান। তিনি ব্রিটিনের অধীনে থেকে যান।
-বেঞ্জামিন স্টোভসহ বিভিন্ন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন বেনজামিনের বহুমাত্রিকতা প্রকাশ করে। আবিষ্কারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ড. ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি। সে সময় বিদ্যুৎকে ভাবা হতো স্বর্গের বিষয়। বেন স্বর্গ থেকে বিদ্যুৎতের ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ আনেন! যে মানুষটা বর্জপাতকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁর শক্তি অনেক বেশি—এমন বিশ্বাস করত প্যারিসবাসীরা।
-ফ্রান্সে ঘুরতে গেলে বেনঞ্জামিন দেখেছিলেন তাঁর ছবি সেখানে বিক্রি হচ্ছে।