বেঞ্চ ঠিক হলেই মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের শুনানি

কাল এ ঘটনার ১৭ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ–সংক্রান্ত মামলার পেপারবুক প্রস্তুত। পলাতক আসামিদের জন্য আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে রাষ্ট্র।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন শেখ হাসিনা

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য পেপারবুক বা মামলার বৃত্তান্ত প্রস্তুত। এখন হাইকোর্টের বেঞ্চ নির্ধারণের পালা। এরপর শুনানি শুরু হবে। ইতিমধ্যে দণ্ডিতদের মধ্যে পলাতক আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র দুজন আইনজীবীও নিয়োগ দিয়েছে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে দলের নেতা-কর্মীসহ ২২ জন নিহত হন। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ কয়েক শ নেতা-কর্মী। আগামীকাল এ ভয়াবহ হামলার ১৭ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে।

ভয়ংকর সেই গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনার তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নানা তৎপরতা চালায়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ–সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) নতুন করে তদন্ত শুরু করে, বেরিয়ে আসে নতুন তথ্য। ২০০৮ সালে ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। তাতে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। পরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। এরপর তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। এ–সংক্রান্ত মামলা দুটি (হত্যা ও বিস্ফোরক) এখন দ্বিতীয় ধাপে হাইকোর্টে শুনানি শুরুর পর্যায়ে রয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ডেথ রেফারেন্সের (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন) জন্য পেপারবুক প্রস্তুত হয়েছে। পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত শুনানির জন্য সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেওয়া হবে। বেঞ্চে নির্ধারণ হলে শিগগিরই শুনানি শুরু হবে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সীমিত পরিসরে আদালতের কার্যক্রম চলে। করোনা পরিস্থিতি না এলে হয়তো এত দিনে মামলার শুনানি শুরু হয়ে যেত।

গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় বিচারিক আদালত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিমসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

■ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ১৯ ■ যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১৯ ■ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ১১ ■ পলাতক ১৭

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৪ জন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) সদস্য। এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং অপর ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

এর মধ্যে কারাগারে থাকা ও জামিনে থাকা দণ্ডিত আসামিরা দুই মামলায় জেল আপিল ও নিয়মিত আপিল করেছেন। সাধারণত বছর ও মামলার ক্রম অনুসারে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়ে থাকে। চলতি বছরের ২০ জুন পর্যন্ত ডেথ রেফারেন্স মামলার সংখ্যা ছিল ৮৫০টি। এখন ২০১৬ সালে আসা ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয়েছে। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতেও ডেথ রেফারেন্স শুনানি হয়। ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানির জন্য বর্তমানে হাইকোর্টে তিনটি বেঞ্চ রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘২১ আগস্টের মামলার পেপারবুকসহ নথিপত্র সতর্কতার সঙ্গে যাচাই–বাছাই চলছে, যা একবারেই শেষ পর্যায়ে। শুনানি–পূর্ব প্রস্তুতির এই প্রক্রিয়া শেষে বিধি অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত শুনানির জন্য সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এ এম আমিন উদ্দিন, অ্যাটর্নি জেনারেল

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ জন

বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ১ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গিনেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ বাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন। এর মধ্যে আবদুর রহিম করোনা আক্রান্ত হয়ে গত রোববার হাসপাতালে মারা গেছেন।

তারেকসহ যাবজ্জীবন যাঁদের

বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ, আরিফুল ইসলাম আরিফ, জঙ্গিনেতা মুফতি আবদুর রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মুরসালিন, মুত্তাকিন, জাহাঙ্গীর বদর, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ, মাওলানা লিটন, মো. খলিল ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।

অন্য মামলায় তিনজনের ফাঁসি কার্যকর

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় মোট আসামি ছিলেন ৫২ জন। তাঁদের মধ্যে হুজি-বি নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের ফাঁসি কার্যকর হয় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায়। আরেক আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। বাকি ৪৯ জনের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালত রায় দেন।

বিভিন্ন মেয়াদে সাজা যাঁদের

বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত ১১ জন হলেন মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক আইজিপি শহুদুল হক, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, জোট সরকার আমলের তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও সাবেক পুলিশ সুপার রুহুল আমীন। নথিপত্র অনুযায়ী, তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীসহ ১৭ জন পলাতক।