কোনো দিন আকাশ মেঘলা। আবার কোনো কোনো দিন বৃষ্টি। শ্রাবণের দিনগুলো এভাবেই যাচ্ছে। প্রতিবছর এমন সময় নতুন গাছ লাগতে মানুষের আগ্রহ বাড়ে। তাই নার্সারিগুলোয় গাছ আর মাটির নানা টবের বিক্রিও বাড়ে। এবার তা হচ্ছে না।
শিশু একাডেমির সামনের ফুটপাতের চারা গাছ বিক্রেতা কামরুল হাসান মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বেচাকেনা নেই বললেই চলে। সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে তাঁর। একই অবস্থা এখানকার মৃৎ ও কুটির শিল্পসামগ্রী বিক্রেতাদেরও। লকডাউন উঠে গেলও বেচাকেনা বিশেষ হচ্ছে না। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসামগ্রী উৎপাদক ও বিক্রেতারা বিপন্ন। দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে এসেছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের হিসাব অনুসারে সব মিলিয়ে ঢাকায় পথের পাশে ও বিভিন্ন মার্কেটে হস্ত ও কুটির শিল্পসামগ্রীর দোকান প্রায় ৪০০। করোনার আগে একেকটি দোকানে প্রতিদিন ন্যূনতম চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মতো বিক্রি হতো। সব দোকান মিলিয়ে মোট বিক্রি হতো ১৬ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকার জিনিস। এখন তা এক লাখেরও নিচে নেমে এসেছে। কারুশিল্পসামগ্রীর প্রধান বিক্রি চৈত্র মাসের মাঝামাঝি থেকে পুরো বৈশাখজুড়ে। সেই ব্যবসা এবার হয়নি। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের মনে এখন এসব শৌখিন সামগ্রীর কেনার আগ্রহ বিশেষ নেই। এ কারণে লকডাউন উঠে গেলেও এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা গভীর সংকটে পড়েছেন। তাঁরা কোনো সাহায্য-সহযোগিতাও পাননি। কেমন করে দিন কাটবে, এই ভাবনায় পীড়িত এসব মানুষ।
রাজধানীতে দোয়েল চত্বর থেকে হাইকোর্ট মোড় পর্যন্ত সড়কেই মৃৎ ও কুটির শিল্পসামগ্রী ও চারা গাছের সবচেয়ে বড় পসরা। এখানে মৃৎ ও কারুশিল্প সম্ভারের দোকান রয়েছে ৪৩টি এবং নার্সারি রয়েছে অর্ধশতাধিক। প্রতিটি দোকানে দিনে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার বিক্রি হতো। রোজ এখানে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা। সেই বিক্রি এখন ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।
ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণির অফিসার্স ক্লাবের পাশে ও পুরোনো এলিফ্যান্ট রোড অংশে আছে প্রায় ১৫টি দোকান। আরও ১৫ থেকে ২০টি দোকান আছে মিরপুর সড়কের ধানমন্ডি এলাকা ও এয়ারপোর্ট রোডের বনানী এলাকার ফুটপাতে। দোয়েল চত্বর, এলিফ্যান্ট রোড ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণির বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল, করোনা পরিস্থিতির কারণে গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত চার মাস তাঁদের বেচাকেনা হয়নি। এখন লকডাউন উঠে গেলও মৃৎ ও কারুশিল্প কেনার প্রতি লোকের আগ্রহ ফেরেনি। খুবই সংকটময় অবস্থায় রয়েছেন মৃৎ ও কারুশিল্পসামগ্রী বিক্রেতা ও উৎপাদকেরা।
সাভার, বরিশাল, সিলেট, কুষ্টিয়া, খুলনা, নওগাঁ, রাজশাহী, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঐতিহ্যবাহী মৃৎ এবং হস্ত ও কারুশিল্পসামগ্রী ঢাকায় আসে। দোয়েল চত্বরের এই বাজার খুচরা বিক্রির পাশাপাশি দিনে দিনে পাইকারি বিক্রির বাজার হিসেবেও গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব–পার্বণ উপলক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক কেনাকাটার জন্য ক্রেতারা এখানেই তাঁদের আগাম ফরমাশ দিয়ে থাকেন।
এবার পয়লা বৈশাখের জন্যও এখানকার বিক্রেতারা বিপুল অঙ্কের ফরমাশ পেয়েছিলেন। ‘সিয়াম মৃৎ ও হস্তশিল্প’ নামের দোকান মালিক বাহার উদ্দিন জানালেন, তিনি পেয়েছিলেন ১২ লাখ ফরমাশ। উৎপাদকেদের আগাম আট লাখ দিয়ে কিছু মালামাল মাল তৈরি করিয়ে এনেছেন, কিছু তৈরি হচ্ছিল। এমন অবস্থায় করোনার সংক্রমণে লকডাউন শুরু হয়ে যায়। এবার পয়লা বৈশাখের উৎসব হতে পারেনি। তাই ফরমাশ বাতিল হয়ে যায়। নকশা করা পাখা, ডালা, কুলা, চালন, শখের হাঁড়ি, মাটির সরাসহ নানা রকম সামগ্রী আটকে আছে।
প্রতিটি দোকানেই এমন অবস্থা। এসব মালামাল দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করার মতো গুদাম দোয়েল চত্বর এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নেই। পয়লা বৈশাখের জন্য তৈরি করা এসব মালামাল তাঁরা জাতীয় তিন নেতার মাজার ও হাজি শাহবাজ মসজিদের পাশে স্তূপ করে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। বৃষ্টিতে অনেক মালামালই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
‘ইমন-সুপ্তা মৃৎ ও হস্তশিল্প’ নামের দোকানের মালিক মফিজুল ইসলাম ১৯৯৪ সাল থেকে শিশু একাডেমির সামনে এই ব্যবসা করেন। তিনি এখানকার ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ। চানখাঁরপুলে থাকেন। তাঁর এক মেয়ে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, ছেলে পড়ে সেগুনবাগিচা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে। বাসাভাড়া, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা, সংসার খরচ মিলিয়ে তাঁর মাসে প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকার খরচ।
আগে দোকানে প্রতিদিন ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা বিক্রি হতো। এতে সংসার চলে যেত। এখন লকডাউন ওঠার পরে এক হাজার টাকাই বিক্রি হয় না। শুকনো কণ্ঠে বললেন, এখন তাঁর হাতে বাজার খরচের টাকাই নেই। খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের (এনসিসিবি) সভাপতি রফিকুল ইসলাম জানালেন, দেশে কারুশিল্পীদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে তাঁতি ছাড়া মৃৎ এবং অন্যান্য কারুশিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এদের উৎপাদিত সিংহভাগই পণ্যের বাজার দৈনন্দিন বাজারভিত্তিক। করোনার জন্য তাদের বেচাকেনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে এসেছে।
কারুশিল্প পরিষদ মনে করে, সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, বেশির ভাগ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পী সেই প্রণোদনার সুযোগ পাবেন না। কারণ, এই প্রণোদনা মূলত ব্যাংকভিত্তিক। এতে এনজিও সঙ্গে যুক্ত খুব সামন্য অংশ হয়তো এই সুযোগ পেতে পারেন। এ কারণে দেশের এসব প্রান্তিক ক্ষুদ্র ও কারুশিল্পীর জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।