সূর্যের উদয়-অস্তের মতো চিরন্তন সত্যে পরিণত হয়েছে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা। টানা কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় শহরের বড় অংশ। সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পক্ষ থেকে হাঁকডাক দেওয়া হলেও কার্যত সমস্যার সমাধান হয় না। গতকাল সোমবার সকালের বৃষ্টিতেও পুরোনো এই সমস্যা আবার সামনে এসেছে। তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল ঢাকা শহর। এতে দিনভর চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় ঢাকাবাসীকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরের সবচেয়ে সমন্বয়হীন অবহেলিত একটি খাত হচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসন। ছয়টি সংস্থা ও বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু সংস্থাগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপায়।
নিকট অতীতে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা হয়েছিল ২০১৭ সালে। ওই সময় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ওয়াদা করে বলেছিলেন, ‘আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে আর এসব (জলাবদ্ধতা) দেখবেন না। কিছুদিনের মধ্যেই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে।’
এই ওয়াদা পালনের জন্য ঢাকার সব খাল, নালাসহ বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনে জড়িত সবকিছুর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার প্রায় আড়াই বছর পর গত ফেব্রুয়ারিতে আগের মন্ত্রীর উত্তরসূরি ও বর্তমান স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বক্স কালভার্টের ভেতর হাজার হাজার টন বর্জ্য জমে আছে। খালগুলোতে প্রবাহ নেই, নদীগুলো দখল হয়ে গেছে।’
গতকাল যোগাযোগ করা হলে তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার সব খাল পরিষ্কার করার কাজে তাঁরা হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু করোনার কারণে কাজের গতি কমে যাওয়ায় সব খাল পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তাহলে জলাবদ্ধতা সমস্যার কোনো সমাধান নেই? জবাবে মন্ত্রী আগের মতোই বলেন, বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও ধলেশ্বরী খনন করা হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকার ৩৯টি খাল পুনঃখনন করা হবে। এসব কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতার সমস্যা কমে আসবে।
২০১৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজে ঢাকা ওয়াসা অন্তত ১০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। সিটি করপোরেশনসহ অন্য সংস্থাগুলোর পৃথক ড্রেনেজ বিভাগ না থাকায় সংস্থাগুলো এই সময়ে পানিনিষ্কাশনের জন্য মোট কত টাকা খরচ করেছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
নগর–পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য মন্ত্রীসহ বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিরা যে আশ্বাস দেন, তার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। তাঁরা নিজেরাও জানেন না, ঢাকায় কত মিলিমিটার বৃষ্টি হলে কোন অংশে কতটুকু জলাবদ্ধতা হবে। এ থেকে রক্ষার জন্য তাঁরা সেভাবে কাজও করছেন না। বিভিন্ন সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে প্রকল্প নিয়ে যে কাজ করছে, তাতে শুধু জনগণের টাকাই নষ্ট হচ্ছে, প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকায় ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত হয়েছে ৬৩ মিলিমিটার। তিন ঘণ্টার এই বৃষ্টিতে মিরপুর রোড, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, নবোদয় হাউজিং, মগবাজার, গ্রিন রোড, বিমানবন্দর সড়ক, মিরপুর, মতিঝিল ও আরামবাগের বড় অংশ ডুবে যায়। পুরান ঢাকার বংশাল, নাজিরাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিল হাঁটুপানি। বিভিন্ন সড়কে বিকল হয়ে যায় বহু যানবাহন। কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকা।
শহরের এমন দুর্ভোগের চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও উঠে আসে। অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ধানমন্ডি ২৭ থেকে ৩২ নম্বর পর্যন্ত এলাকার (মিরপুর রোড) জলাবদ্ধতার ভিডিও দিয়ে একজন লিখেছেন, ‘লকডাউনে যাঁরা কক্সবাজার যেতে পারেননি, তাঁরা এখানে এসে সাঁতার কাটতে পারেন।’
কয়েক বছর ধরেই ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে জলাবদ্ধতা হচ্ছে। গত বছর এই এলাকায় নালা সংস্কারের কাজও হয়েছে, এখনো চলছে। তারপরও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। জলাবদ্ধতার কারণে ব্যস্ত এই সড়ক একেবারে স্থবির হয়ে যায়, দীর্ঘ যানজট আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
গতকালের অবস্থা সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পশ্চিম ট্রাফিকের অতিরিক্ত উপকমিশনার মঞ্জুর মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, জলজটে সবচেয়ে বাজে অবস্থা ছিল ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে। জলজট থেকে সৃষ্ট যানজট ধানমন্ডি থেকে অন্য জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হয়। তিনি বলেন, এমন বৃষ্টি চলতে থাকলে জলজট-যানজটে ঢাকার অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠবে।
শোচনীয় অবস্থা ঠেকাবে কে
আইন ও কর্মপন্থা অনুযায়ী, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড জড়িত। এর বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানও জলাবদ্ধতা নিরসনে ভূমিকা রাখে। তবে মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। এ সংস্থার নিয়ন্ত্রণে থাকা বড় আকারের পানিনিষ্কাশন নালা ও খাল দিয়েই মূলত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হয়। তুলনামূলকভাবে ছোট নালা, কয়েকটি খাল এবং কয়েক কিলোমিটার বক্স কালভার্ট দেখভাল করে দুই সিটি করপোরেশন। তবে সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ নালার সংযোগ দেওয়া আছে ওয়াসার নালার সঙ্গে। পুরো শহর নিয়ে পরিকল্পনার পাশাপাশি হাতিরঝিল, উত্তরা ও গুলশান-বনানী এলাকার খাল আছে রাজউকের আওতায়। ঢাকা শহরের চারপাশের স্লুইসগেটগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করে পাউবো। সেনানিবাস এলাকার পানি নিষ্কাশন করে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকার পানিনিষ্কাশনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট আবাসন প্রতিষ্ঠানের।
ছয় সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণে ঢাকায় জলাবদ্ধতা হয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি (বিআইপি) অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, সংস্থাগুলোর মধ্যে ন্যূনতম সমন্বয় নেই, এমনকি সমন্বয় করার মতো মানসিকতাও নেই। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সিটি করপোরেশনের হাতে সব দায়িত্ব দেওয়া উচিত, যেন এক সংস্থা সব কাজ করতে পারে।
কী করছে ওয়াসা
ছয় সংস্থার হাতে দায়িত্ব থাকলেও ঢাকা শহরের বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু সংস্থাটি এখন আর এই দায়িত্ব পালন করতে চায় না। এ খাতে আয় না থাকায় খাতটি নিয়ে ওয়াসা তেমন মনোযোগী নয়। তাই গত তিন-চার বছরে ওয়াসার নেতৃত্বে ড্রেনেজ নেটওয়ার্কও প্রয়োজন অনুযায়ী সম্প্রসারিত হয়নি, যা আছে সেগুলোও ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি।
ওয়াসার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কয়েক বছর ধরে ওয়াসা ড্রেনেজ খাতের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে কোনো বরাদ্দ দেয় না। মন্ত্রণালয়ের অনুদানের আশায় চেয়ে থাকে। মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দিলে কাজ হয়, না দিলে হয় না।
ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটির অধীনে প্রায় ৩৮৫ কিলোমিটার পানিনিষ্কাশনের বড় নালা, ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট এবং প্রায় ৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি খাল আছে। কিন্তু যথাযথভাবে এর সব কটি কোনো অর্থবছরেই পরিষ্কার বা সংস্কার করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
ওয়াসার গতিহীন দুই প্রকল্প
ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের কথা বলে ‘ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও খাল উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে একটি এবং ‘হাজারীবাগ, বাইশটেকী, কুর্মিটোলা, মান্ডা ও বেগুনবাড়ি খালে ভূমি অধিগ্রহণ এবং খনন/পুনঃখনন প্রকল্প’ নামে আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। ওয়াসার ভাষ্য, প্রায় ১১ কোটি টাকার এই প্রকল্প দুটি শেষ হলে ঢাকার জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমে আসত। প্রকল্প দুটির মেয়াদ এখন শেষের দিকে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১৯ দশমিক ১৬ শতাংশ, অন্যটির অগ্রগতি মাত্র দেড় শতাংশ।
সার্বিক বিষয়ে নগর গবেষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, অবস্থা দেখে তো মনে হয়, পানিনিষ্কাশনকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথবা মুখে গুরুত্ব দিয়ে বললেও বাস্তবে কেউ যথেষ্ট কাজ করে না। সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করলে আজকের অবস্থা তৈরি হতে না।