বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। সেই জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন।
আইনজীবী বীরেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন রাজশাহীতে সর্বজনশ্রদ্ধেয়। সমাজসেবামূলক নানা কাজেও তাঁর ভূমিকা ছিল। এ ছাড়া প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন গরিবের বন্ধু। তাঁদের হয়ে বহু মামলা লড়েছেন, কিন্তু কোনো টাকা নেননি। বরং উল্টো তাঁদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন।
ব্রিটিশ যুগে বীরেন্দ্রনাথ ছিলেন বিপ্লবী দলের সদস্য। এ জন্য তাঁকে জেলে ও বহুদিন আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। ভারত ভাগের পর পূর্ব বাংলার (তখন পূর্ব পাকিস্তান) প্রতি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার।
একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় সভা, সমাবেশ ও মিছিলে বীরেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন বিশেষ ভূমিকায়। ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে তিনি মাতৃভূমি ত্যাগ করে যাননি। তাঁর গভীর বিশ্বাস ছিল, ‘অজাতশত্রু মানুষ আমি, কেউ আমাকে হত্যা করবে না।’
৩ এপ্রিল রাজশাহী শহরে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল রাতে বীরেন্দ্রনাথের বাড়ি ঘেরাও করে। সেনারা ঘর থেকে টেনে বের করে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় তাঁর শরীর।
এ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় সাংবাদিক সাঈদউদ্দীন আহমদের রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘গণ-আন্দোলনের পর কিছু কিছু হিন্দু ভারতে চলে গেলে অনেকেই বীরেনদাকে চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। মনে পড়ে, একবার এক পরামর্শদাতাকে কড়াভাবে শুনিয়ে দিয়েছিলেন—চলে যাব? পালাব? দেশ ভাগ হওয়ার পর যাইনি, এখন যাব? লোকে বলবে বীরেন সরকার কাপুরুষের মতো পালিয়ে গেল? এই মাটিতে জন্ম, এখানেই মরব। বীরেনদা মরলেন না। শহীদ হয়ে অমর হলেন। ১৯৭১-এর ৩ এপ্রিল বোরকা পরে এক পাকিস্তানি দোসর তাঁর বাড়ি চিনিয়ে দেয়।
‘আমরা যখন এই জন্মভূমি প্রিয়, অকৃতদার, খ্যাতিমান আইনজীবী, বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, খেলোয়াড়কে দেখতে পেলাম, দেখলাম তাঁর দেহ পড়ে আছে অর্ধেক খাটে, অর্ধেক মেঝেয়।’ (‘আমার সিনিয়র’, স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৯, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।
বীরেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন একাধারে বিপ্লবী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াবিদ ও সাংবাদিক। ভালো মানের ফুটবল রেফারিও ছিলেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রাজশাহীতে বড় বড় ম্যাচে রেফারির বাঁশি তাঁর হাতেই দেখা যেত।
রাজনৈতিক জীবনে বীরেন্দ্রনাথ সরকার প্রথম ছিলেন কংগ্রেসের বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের (বিভি) সদস্য। কংগ্রেসে থাকাকালে ১২ বছর জেল খাটেন। যাঁদের সঙ্গে তিনি রাজনীতি করেছেন, তাঁদের মধ্যে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ও রাজশাহীর প্রভাষচন্দ্র লাহিড়ী উল্লেখযোগ্য। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি রেভল্যুশনারি সোসালিস্ট পার্টিতে (আরএসপি) যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কিছুদিন রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। পরে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আহ্বানে ন্যাপে যোগ দেন। কয়েক বছর পর ন্যাপ বিভক্ত হলে মোজাফ্ফর ন্যাপের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭০ সালে এই দলের হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
সংগ্রামী নারী ইলা মিত্রের মামলায় বীরেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন কনিষ্ঠ আইনজীবী। ইলা মিত্রের ওপর জেলখানায় চরম অত্যাচার করা হয়। সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে তাঁর পক্ষে মামলা করার জন্য প্রথম দিকে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা এগিয়ে আসেননি। এই মামলায় সরকারপক্ষের বাঘা বাঘা আইনজীবীর সঙ্গে লড়াই করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।
রাজশাহী প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বীরেন্দ্রনাথ সরকার। কয়েকবার তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হন।
বীরেন্দ্রনাথ সরকারের জন্ম রাজশাহীর বাগমারা থানায়। রাজশাহী বিবি হিন্দু একাডেমি থেকে প্রবেশিকা (১৯৩২) ও রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ (১৯৩৬) ও বিএ (১৯৩৮) পাস করেন। কারাবন্দী থাকা অবস্থায় বিএল (১৯৪২) পাস করেন। ১৯৪৫ সালে কারামুক্ত হয়ে আইন পেশায় যোগ দেন।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
<rashedtr@prothom-alo.info>