অ্যালেন খান অস্ট্রেলিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয় বিয়ের আলোকচিত্রী। বিয়ের ছবি তোলায় সেরাদের সেরা তিনি। তিনি শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই জনপ্রিয় নন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে তাঁকে ছুটতে হয়, তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন রাঙাতে।
এখন চলছে ২০১৭। অথচ অ্যালেন খানের সময় নিয়ে রাখা হয়েছে ২০১৯ সালের বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য! অনেক তরুণ-তরুণীই স্বপ্ন দেখে থাকেন, তাঁর বিয়ের দিনের ছবিটি তুলবেন অ্যালেন খান। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে হলে এক বছরেরও আগে তাঁর সময় নিতে হয়। অনেকে দু-তিন বছর আগেও তাঁর সময় নিয়ে রাখেন, পাছে স্বপ্ন যেন স্বপ্নই থেকে না যায়! এমনও অনেকে আছেন, অ্যালেন খানের শিডিউল না পেয়ে পিছিয়ে দিয়েছেন তাঁদের বিয়ের তারিখ!
বুকে গর্ব নিয়ে বলতে হয়, অ্যালেন খান কোনো অস্ট্রেলীয় আলোকচিত্রী নন। তিনি একজন বাংলাদেশি। কাগজে-কলমে তাঁর নাম হেদায়েতুল্লাহ খান। ফ্লাইং ক্লাবে তাঁর এক বিদেশি প্রশিক্ষক তাঁকে অ্যালেন নামে ডাকতেন। সেই থেকে তিনি অ্যালেন খান নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন সবার কাছে। একসময় পাইলট হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। তৎকালীন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে এক বুক অভিমান নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। নতুন দেশ। নতুন জীবনের শুরুটা সহজ ছিল না। অনেক আজেবাজে চাকরি করেছেন। ট্যাক্সি চালিয়েছেন। কিন্তু কখনো হাল ছেড়ে দেননি।
সেরা হওয়ার জন্য অ্যালেন খান মুখাপেক্ষী ছিলেন না কখনোই। শুধু নিজের কাজটাই ভালোবেসে মনোযোগ দিয়ে করে গেছেন। অস্ট্রেলীয় টেলিভিশন ‘এসবিএস’ তাঁকে ‘কিংস অব সিডনি ওয়েডিং ফটোগ্রাফার’ বলে আখ্যায়িত করে। টেলিভিশনটি তাঁকে নিয়ে এক বছর ধরে একটি ভিডিওচিত্র নির্মাণ করে। ব্রাইডস অব খান নামের সেই প্রামাণ্যচিত্র ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ান ব্রাইডাল ইন্ডাস্ট্রি একাডেমি ২০০৬ সালে তাঁকে নির্বাচিত করেছে সেরা আলোকচিত্রী হিসেবে।
‘অ্যালেন খান ওয়েডিং ফটোগ্রাফি অ্যান্ড ভিডিও’ সেই ১৯৮২ সাল থেকে এখনো জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। এর কারণ জানতে চাইলে এই গুণী আলোকচিত্রশিল্পী বলেন, ‘আমরা ক্লায়েন্টের পছন্দকে গুরুত্ব দিই। বিয়ের আগে কাউন্সেলিং করি। পাশাপাশি আমরা খুব দ্রুত ক্লায়েন্টের ছবি, ভিডিও আর অ্যালবাম ডেলিভারি দিই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমরা ততটুকুরই প্রতিজ্ঞা করি, যতটুক আমরা দিতে পারি। আসলে আমরা যা প্রতিজ্ঞা করি, তার থেকে একটু বেশি দিই, ১১০ শতাংশ যাকে বলে!’
এত এত বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে কিন্তু অ্যালেন খানের মনে দাগ কেটে আছে নিউইয়র্কে এক ইতালীয় দম্পতির ছবি তোলাটা। এ ছাড়া সেলিম মাহাজার বিয়ের অনুষ্ঠানের গল্পও তিনি সুযোগ পেলেই বলেন। ১৯৯০ সালে ফিজিতে একটি বিয়ের ছবি তুলেছিলেন তিনি। তাঁর কাজে মুগ্ধ হয়ে কনের বাবা তাঁকে সোনায় মোড়া একটা নাইকন ক্যামেরা উপহার দেন।
একই পরিবারের দুই প্রজন্মের বিয়ের ছবি তোলার অভিজ্ঞতা আছে অ্যালেন খানের। এ বছর এমন তিনটি বিয়ের ছবি তুলেছেন তিনি, যাঁদের মায়ের বিয়ের ছবিও তিনি তুলেছিলেন ১৯৮৭, ১৯৮৯ ও ১৯৯১ সালে।
অ্যালেন খান বলেন, বাংলাদেশে এসেও তাঁর বিয়ের ছবি তোলার প্রত্যাশা আছে। তাঁকে দিয়ে ছবি তোলানো অবশ্য অসম্ভব খরুচে একটি ব্যাপার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১০ থেকে ২০ লাখ খরচ করতে হয় অ্যালেন খানের তোলা অসামান্য বিয়ের ছবি সংগ্রহে রাখতে হলে। তবু তাঁর শিল্পকর্ম, তাঁর কাজকে দামি না বলে অমূল্যই বলা উচিত।
বাংলাদেশের খুবই বিশিষ্ট একটি পরিবারের সন্তান অ্যালেন খান। তাঁর বাবা ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার আবদুল জব্বার খান। মা ফিরোজা বেগম ছিলেন গৃহিণী। তাঁর আট ভাই ও পাঁচ বোনের অধিকাংশই বিশিষ্ট। এনায়েতুল্লাহ খান ছিলেন ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এর সম্পাদক, সাদেক খান চিত্র পরিচালক ও লেখক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান ছিলেন কবি, সচিব ও পরে মন্ত্রী, রাশেদ খান মেনন বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, শহীদুল্লাহ খান বাদল শিল্পপতি, সুলতান মাহমুদ খান যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী স্থপতি, আমানউল্লাহ খান অস্ট্রেলিয়া সরকারের উচ্চপদে চাকুরে। বোন সেলিমা রহমান ছিলেন বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রী; আরেক বোন শিরিন খান লন্ডনপ্রবাসী।
ছবি তোলার পুঁথিগত কোনো বিদ্যা অ্যালেন খানের ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন কনফারেন্সে যেতেন তিনি। সেখান থেকেই তিনি শেখেন, অনুপ্রাণিত হন। নতুন প্রজন্মের আলোকচিত্রীদের ক্ষেত্রেও তিনি উদার। তাঁদের তিনি এই পেশায় আসার জন্য স্বাগত জানান। তবে তিনি বলেন, ছবিতে নতুনত্ব থাকতে হবে। এ-ও বলতে ভোলেন না যে ভালো ছবি তোলার পাশাপাশি ভালোভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে এবং কথা বলতেও শিখতে হবে।
কাজের মান কীভাবে ধরে রাখতে হয়? এ প্রশ্ন উঠলেই অ্যালেন খান শুনিয়ে দেন তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা। ‘একদিন সিডনির বিখ্যাত এক গাড়িবিক্রেতার ব্যক্তিগত সহকারী এলেন আমার কাছে। গাড়িবিক্রেতার মেয়ের বিয়ের ছবি তোলাবেন। সীমিত সময়ের মধ্যে কাজ করতে হবে। টাকাপয়সা মোটামুটি যা চাই, তা-ই দেবেন। কিন্তু আমি দেখছিলাম, ওই সময়ের মধ্যে মোটেও ভালো কাজ করা যাবে না। তাই তাঁদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম।’ রাতে স্বয়ং গাড়িবিক্রেতা ফোন করে জানতে চান, কেন অ্যালেন খান কাজটা করবেন না। অ্যালেন খান তাঁকে বলেছিলেন, ‘যদি কেউ টাকা নিয়ে রাতদুপুরে গাড়ি কিনতে চায়, তুমি নিশ্চয়ই দোকান খুলে বসবে না। আমিও আমার কাজটা আমার মতো করতে চাই।’ গাড়িবিক্রেতা আমার কথা বুঝেছিলেন এবং অনেক সময় নিয়েই অনুষ্ঠানটা করতে বললেন।
এত বছর কাজ করার পরও একঘেয়েমি তাঁকে আজও কাবু করেনি। তিনি আনন্দে মেতে থাকেন সব সময়। প্রতিবছরই শুরু করেন নতুন করে—নতুন বিয়ে, নতুন দম্পতি। অ্যালেন খান তাই এখন শুধু একটা নামই নয়, নিজেই হয়ে উঠেছেন একটি ব্র্যান্ড—যার মূল পুঁজি অসামান্য সততা ও কঠোর পরিশ্রম। তিনিই সিডনির প্রথম আলোকচিত্রী, যিনি ছবি তুলে নিজের জন্য একটি রোলস রয়েস সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু শুধু আর্থিক সামর্থ্যই তো নয়, সম্মানও তিনি পেয়েছেন অঢেল। আর এই জায়গায় পৌঁছানোর জন্য নিজের ব্র্যান্ডটি তাঁকে গড়ে তুলতে হয়েছে তিলে তিলে।
প্রীত রেজা: বিয়ের আলোকচিত্রগ্রাহক।