আয়রনম্যান! ৩০ বছর বয়সী মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি দৌড়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পাড়ি দেবেন বলে বের হন। রোজ দৌড়াবেন ৫০ কিলোমিটার। ২০ দিনে হাজার কিলোমিটার। এই কাজ করার জন্য অনেক আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করেন। টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনস বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পার হন। কিন্তু দৌড়ে টেকনাফ-তেঁতুলিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে পড়েন অভাবনীয় এক বাধার সম্মুখে। বঙ্গবন্ধু সেতু যানবাহনে ছাড়া পার হওয়ার নিয়ম নেই। তাহলে কি স্বপ্ন পূরণ হবে না আরাফাতের? না, আরাফাত হেরে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি ঝাঁপ দেন যমুনা নদীতে। সাঁতরে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার যমুনা পার হয়ে ওপারে ওঠেন। তারপর আবারও দৌড়। কুড়ি দিনে তিনি সহস্রাধিক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছান বাংলাবান্ধা।
প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আরাফাতকে নিয়ে নির্মিত ও প্রচারিত আয়রনম্যান তথ্যচিত্রটি এরই মধ্যে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। প্রথম আলো ফেসবুক পেজে তিন দিনে এটা দেখেছেন ২০ লাখের বেশি মানুষ, তারও চেয়ে বড় কথা, এটা শেয়ার হচ্ছে হাজার হাজার, ৩৫ হাজারের বেশি শেয়ার শুধু প্রথম আলো পেজ থেকে, আর বিভিন্ন গ্রুপ/পেজ থেকে এই ভিডিও পোস্ট হচ্ছে, সেসবেও লাইক, শেয়ার, কমেন্টসের ইয়ত্তা নেই। আনন্দের বিষয়, রেদওয়ান রনি নির্মিত আয়রনম্যান ভিডিওর নিচে হাজার হাজার মন্তব্য দারুণ ইতিবাচক! সবাই বলছেন, আয়রনম্যান আরাফাত, যিনি আমেরিকা, মালয়েশিয়া নানান দেশের কঠিন ট্রায়াথলন আয়রনম্যান চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় সাফল্যের সঙ্গে উড়িয়েছেন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা, তিনি আমাদের প্রেরণার প্রতীক। সবাই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মালয়েশিয়া, জার্মানি, থাইল্যান্ড ও সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রে আয়রনম্যান চ্যাম্পিয়নশিপ সম্পন্ন করা আরাফাতকে নিয়ে মানুষের ভালোবাসার প্রকাশ যেন থামছেই না। আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার সাঁতার, ১৮০ কিলোমিটার সাইক্লিং, ৪২ দশমিক ২ কিলোমিটার দৌড় সম্পন্ন করতে হয় ১৭ ঘণ্টার মধ্যে।
ফেসবুকে এই তথ্যচিত্রের মন্তব্যে সিফাত আলম লিখেছেন, ‘দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। অসাধারণ অনুভূতি। দেশের পতাকা নিয়ে শেষ মুহূর্তে যখন পৌঁছাল, একজন বীর প্রতীক তাকে অভিবাদন দিলেন, ভেতর থেকে এত গর্ব অনুভব করলাম।’
একজন মন্তব্য করেছেন, ‘প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটা সেরা উপহার।’
কেন মানুষ এই সাফল্যের ভিডিও দেখে কাঁদছে? আবেগে। কিসের আবেগ? বাধা না মানার। যমুনা সাঁতরে পার হওয়ার দৃশ্য দেখার! এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশপ্রেম। আরাফাতের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন। তিনি থাকেন নোয়াখালীতে। ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) ছিলেন। একাত্তরে পোস্টিং ছিল রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে। ২৭ মার্চ থেকে তেঁতুলিয়া এলাকাকে মুক্ত করে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ২০১৭ সালে তেঁতুলিয়ার পথে ছেলে আরাফাত যখন রংপুর পৌঁছান, বাবা মোশাররফ হোসেন ছেলেকে বলেন, বধ্যভূমি দেখে এসো, শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসো। আরাফাতের গল্প নতুন মাত্রা পায়। তেঁতুলিয়া থেকে বাংলাবান্ধায় যাচ্ছেন আরাফাত। সঙ্গে যোগ দেন আরও আরও তরুণ। মন্তব্যের ঘরে ঠিকই একজন লিখেছেন, বাংলাদেশের ফরেস্ট গাম্প (টম হ্যাংকস অভিনীত ছবি ফরেস্ট গাম্প-এ একই রকমের দৃশ্য ঘটে, টমের হাঁটার সঙ্গে আরও মানুষ যোগ দেয়)।
তারপর বাংলাবান্ধা নিকটবর্তী হচ্ছে। আরাফাত কপালে বাঁধলেন লাল-সবুজ পতাকা। জিরো পয়েন্টে তাঁকে বরণ করে নিতে এসেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বীর প্রতীক, আরাফাতের আব্বার সঙ্গে যিনি যুদ্ধ করেছিলেন। বীর প্রতীক বাংলাবান্ধায় বরণ করে নিলেন আরাফাতকে।
আবদুল মান্নান বীর প্রতীকের কাহিনিও ভীষণ বীরত্বপূর্ণ। নোয়াখালীর এই ভদ্রলোক এখন স্থায়ী হয়েছেন তাঁর যুদ্ধের ময়দান তেঁতুলিয়ায়। ইপিআরে ছিলেন। ১৯৭১-এর মার্চ থেকেই বিদ্রোহ করে তেঁতুলিয়া এলাকাকে মুক্ত করে এগোচ্ছিলেন সৈয়দপুরের দিকে। মে মাসের দিকে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। বাংকারে ধরা পড়েন আবদুল মান্নান। তাঁকে বন্দী করে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে প্রতিদিন চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। তারপর রংপুর ক্যান্টনমেন্ট। অকথ্য নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বিচার করে দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড।
রংপুর উপশহরে দিঘির পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয় মান্নানসহ আরও আরও সামরিক-বেসামরিক বাঙালি বন্দীকে। লাইন করে দাঁড় করানো হলো। গুলি হলো। গুলি মান্নানের গলা ভেদ করে চলে গেল। মান্নান পড়ে গেলেন। তখন বিকেল। রাত তিনটার দিকে তাঁর জ্ঞান ফিরল। কোনোরকমে গেলেন এক হারিকেনজ্বলা কুটিরে। তাঁকে শেষে ভারতে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হলেন গ্রামবাসী। ভারতের হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বিজয়ের পরে দেশে ফেরেন বীর প্রতীক মান্নান। কিন্তু তাঁর সঙ্গীদের বাকি সবাই সেই খুনির দিঘির পাড়েই শহীদ হন।
বীর প্রতীক আবদুল মান্নান যে পতাকা তুলে দিয়েছেন আরাফাতের হাতে, তাতে লাখো শহীদের রক্ত লেগে আছে! সেই পতাকা নিয়ে বাংলাদেশের অপরাজেয় তারুণ্যের প্রতীক আরাফাত ছুটে চলেছেন আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া ইয়াসমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করছেন। ২০ নভেম্বর ২০২১ প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে র্যাডিসন হোটেলের মিলনায়তনে মন্ত্রী-নেতা-বুদ্ধিজীবী-ব্যবসায়ী-গণ্যমান্য মানুষেরা আরাফাতের তথ্যচিত্র দেখে একযোগে দাঁড়িয়ে তালি দিচ্ছিলেন যখন, সুমাইয়া বলেন, তিনি তখন থরথর কাঁপছিলেন। চোখের জল মুছছিলেন আরাফাত। ভিডিওটা প্রচারের পর আরাফাত আবেগে ঘুমাতে পারেন না। ২১ নভেম্বর চলে আসেন প্রথম আলো অফিসে। সুমনা শারমীন, রেদওয়ান রনি, পল্লব মোহাইমেনের সঙ্গে সময় কাটান। জানান, চারদিক থেকে তিনি পাচ্ছেন অভিনন্দন আর শুভকামনা। ২২ ও ২৩ নভেম্বর আবার তিনি আসেন প্রথম আলো কার্যালয়ে। এখন তিনি প্রথম আলোর একজন নিকটজনে পরিণত হয়ে গেছেন। প্রথম আলোকে জানাচ্ছেন কৃতজ্ঞতা। চোখ ভিজে আসে তাঁর কৃতজ্ঞতায় আর আবেগে। স্মরণ করছেন, প্রথম আলো অনেক আগে থেকেই তাঁর অভিযানগুলোর খবর প্রচার করে এসেছে। প্রথম আলোয় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে অনেকগুলো—‘আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ সম্পন্ন করলেন আরাফাত’ (২১ সেপ্টেম্বর ২০২১), ‘আরাফাত এবার আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে’ (১ সেপ্টেম্বর ২০২১), ‘তাঁরা আয়রনম্যান’ (২৭ জুলাই ২০১৯), ‘বাংলাদেশের “আয়রনম্যান” আরাফাত’ (১২ নভেম্বর ২০১৭)। তিনি জানাচ্ছেন তাঁর পরের পরিকল্পনা। ২৭টা লক্ষ্য আছে তাঁর। এই মুহূর্তে তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন অষ্টমবারের মতো বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার। এরপর যাবেন আয়রনম্যান আসরে, ফিলিপাইনে। এবার চান আরও দ্রুতগতি অর্জন করতে, আরও কম সময়ে পাল্লা শেষ করতে।
দেশের তরুণেরা তাঁর কাছ থেকে প্রেরণা পাচ্ছেন, এটা তাঁর জন্য অনেক বড় একটা প্রাপ্তি। তাঁদের আড়াই বছরের ছেলে আহিয়াশ তথ্যচিত্রটা দেখে আর বলে, আমিও নদী সাঁতরাব, আমিও দৌড়াব। আরাফাত রোমাঞ্চিত হন।
তাঁর আব্বা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ আর তাঁর আব্বার বন্ধু বীর প্রতীক আবদুল মান্নানেরা শহীদের রক্তে আঁকা পতাকা দিয়েছেন আরাফাতের হাতে। আরাফাত সেই পতাকা দিয়ে যাবেন আহিয়াশকে। এই লাল-সবুজের মানে বাধা না মানা। থেমে না যাওয়া। আরাফাতরা বাধা পেলে দমে যান না। আহিয়াশরাও দমবে না। বাংলাদেশ দমবে না। বাধা আসবে। বাংলাদেশ বাধা পেরোবেই। বাংলাদেশ বিজয়ী হবে। এই বাংলাদেশ তারুণ্যের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী বাংলাদেশ।