সরকারি চাকরির প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার কড়া সমালোচনা করলেন শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ‘আমরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখন বিসিএস চর্চায় আছি। আমি বলি, “বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়” নামে একটা বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হোক। সেখানে “প্রিলিমিনারি পরীক্ষা”, “ভাইভা” ইত্যাদি নামে বিভাগ থাকবে। দারুণ চলবে কিন্তু।’
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে এক পাবলিক লেকচারে সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এসব কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজমুল করিম স্টাডি সেন্টার ‘৫০-এ বাংলাদেশ: অতীত, বর্তমান এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এই বক্তৃতার আয়োজন করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে জনপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যাবে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা পাত্তা পাবেন না। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সেখানে প্রাধান্য দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টর ইত্যাদি হওয়ার জন্য আজকে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি। আমি মনে করি, আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে। আমরা সব সময় অন্যের দিকে আঙুল তুলি, নিজের দিকে তুলি না। সমালোচনা যদি সবার ভেতর থেকে শুরু হতো, তাহলে হতাশা থাকত না।’
একাত্তরে সমর্পিত হওয়া এখন একটা গালি হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এর জন্য আমরা নিজেরাই হয়তো দায়ী। আমাদেরই একজন শিক্ষককে সেদিন বলতে শুনলাম, “চেতনাপন্থী”৷ এর মানে কী? আমি একাত্তরকে জানব না, এর বিপরীতে দাঁড়াব আর এই দেশে থাকব, সেটি কি সম্ভব?’ তিনি বলেন, ‘একাত্তরটাকে বুঝতে হবে। এটি আমাদের জাতিসত্তার বিকাশের একটি মাহেন্দ্রক্ষণ। বাংলাদেশ কেন এত দূর যেতে পারল না, তার কারণটা হচ্ছে একাত্তরের কয়েক মাসের মধ্যে আমরা একাত্তরকে ভুলে গিয়েছিলাম।’
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘এই দেশেরই কিছু মানুষ একাত্তরে স্বজন হত্যা করেছে। এতে তারা লজ্জা পায়নি, ক্ষমা চায়নি এবং ভুলও স্বীকার করেনি। এখনো তারা সদম্ভে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। আমাদের দেশের এক বিশাল সংখ্যার মানুষ এখনো একাত্তরকে গ্রহণ করতে পারেনি। আমাদের স্বাধীনতা কেউ দেয়নি, যুদ্ধ করে অর্জন করেছি। একজন মানুষ বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে (স্বাধীনতার) ডাক দিয়েছিলেন। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আজকাল বলতে শুনি, ৭ মার্চে এমন কী হয়েছিল! ৭ মার্চ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করে দিয়েছিল। আমি সেই পরিবর্তনের সাক্ষী। আমি কোনো দলের নই, আমি একাত্তরের।’
বক্তৃতা অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তিনটি কারণে আলাদা। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে একমাত্র গণপ্রজাতন্ত্র; এ অঞ্চলে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যারা একটি স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে এবং এই দেশের অনন্য পররাষ্ট্রনীতি।
বাংলাদেশের সামনে পাঁচটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন ইমতিয়াজ আহমেদ। তাঁর মতে এগুলো হলো, রোহিঙ্গা সংকট, করোনার মহামারিতে সৃষ্ট পরিস্থিতি, একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার পূর্বশর্ত, দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও নতুন বিক্ষিপ্ত জনগোষ্ঠী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অথবা নতুন স্নায়ুযুদ্ধ৷
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার রাজনীতি আমাদের শেখালে হবে না। নিষেধাজ্ঞা কী, তা আমরা জানি। বেআইনি যুদ্ধ করা কোনো রাষ্ট্রকে আমি গণতান্ত্রিক বলে মনে করি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র এমন অনেক বেআইনি যুদ্ধ করেছে। এমন একটি দেশকে কীভাবে গণতান্ত্রিক বলা যায়, তা আমার মাথায় ঢোকে না। শুধু তাদের একটি নির্বাচন আছে বলে? হিটলার, মুসোলিনি, নরেন্দ্র মোদিও তো নির্বাচিত। ফলে কীভাবে আমরা মনে করতে পারি, এটাই গণতন্ত্রের সবকিছু।’
ইমতিয়াজ আহমেদ আরও বলেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক থাকতে হয়। এটি আমাদের দেশে অনুপস্থিত। এর পেছনে ঐতিহাসিক কারণও আছে। কিছু দল আছে, যারা একাত্তর ও গণহত্যাকে মানতে চায় না। এটি একটি গুরুতর সমস্যা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনাকেও ভুলে যাওয়া যায় না। ওই হামলার ঘটনাস্থল থেকে হাঁটার পথ হলেও পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক সেখানে যাননি। এটা কীভাবে সম্ভব? ফলে ওই আস্থাটা তৈরির কোনো চেষ্টা নেই। বিভাজনের রাজনীতি নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করা সম্ভব নয়। দলগুলো বিরোধী দলে গেলে গণতান্ত্রিক আর ক্ষমতায় গেলে কম গণতান্ত্রিক—এটাই মূল সমস্যা।
ইমতিয়াজ আহমেদের প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি শোষণমুক্ত, সমাজতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও আলোকিত মানুষের বাংলাদেশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন এসব ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে আমরা একে অপরের চোখে চোখ রেখে কথা বলাটা খুব কষ্টকর হয়ে যেতে পারে। ৫০ বছরে বাংলাদেশে যা হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি।
নাজমুল করিম স্টাডি সেন্টারের পরিচালক আ ক ম জামাল উদ্দীনের সঞ্চালনায় এই বক্তৃতা অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘের সেন্ট্রাল ইমার্জেন্সি রেসপন্স ফান্ড-অ্যাডভাইজারি গ্রুপের উপদেষ্টা মো. আবদুল হান্নান।