মহামারি আকারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বের ১১০টি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ১০০ কোটি শিশু-কিশোর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশু-কিশোর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে চীনে। ওই তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। চীনে ২৩ কোটি ৩০ লাখ ও বাংলাদেশে ৩ কোটি ৬৭ লাখ শিশু স্কুলে যাচ্ছে না। ওই তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের নাম।
গত বুধবার জাতিসংঘের দুর্যোগবিষয়ক ওয়েবসাইট রিলিফ ওয়েবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। তবে সংস্থাটি এ–সংক্রান্ত সব তথ্য সংগ্রহ করেছে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) একটি প্রতিবেদন থেকে। এই পরিস্থিতিতে ইউনিসেফ থেকে বিশ্বের শিশুদের শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে। তারা গত বৃহস্পতিবার বিশ্বের ৭৩টি দেশের শিক্ষামন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। অনলাইন বা ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যবহার করে এসব শিশুর কীভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীদের মতামত জানতে চেয়েছে তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব আকরাম-আল-হাসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর আমরা এখন চিন্তা করছি কীভাবে ঘরে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া যায়। ইতিমধ্যে আমরা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি উদ্যোগ নিয়েছি। সংসদ টিভি নামে যে চ্যানেলটি রয়েছে, তাদের সঙ্গে আমাদের এ নিয়ে কথা হয়েছে। তারা যাতে শিশুদের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রমবিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচার করে যায়, সে ব্যাপারে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশের সব বাসায় টেলিভিশন নেই, ফলে যাদের বাসায় টেলিভিশন আছে এবং যাদের নেই, তাদের মধ্যে একটি বৈষম্য তৈরি হতে পারে। সেই বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছি।’
অন্যদিকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া নিয়ে আরেক ধরনের উদ্বেগের কথা বলা হয়েছে। সংস্থাটি বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র শিশুদের স্কুলে বিনা মূল্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয় উল্লেখ করে এই আশঙ্কা করা হয়েছে যে স্কুলগুলো বন্ধ থাকলে শিশুরা উন্নত খাবার থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে তাদের পড়াশোনার আগ্রহ কমে গিয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও কঠিন হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছে ইউনিসেফ। বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের এই সময়টাতে পড়াশোনা থেকে আরও বেশি দূরে চলে যেতে পারে। তাদের পারিবারিক কাজে বেশি করে যুক্ত করার ফলে তারা পড়াশোনায় ছেলেদের চেয়ে পিছিয়ে পড়তে পারে। ঝরে পড়া শিশুদের মধ্যে মেয়ে শিশুদের সংখ্যা বেশি হতে পারে বলেও মনে করছে ইউনিসেফ।
অন্যদিকে ইউনিসেফ থেকে অনলাইনের মাধ্যমে শিশুরা বাসায় বসে শিক্ষা নেওয়ার যে উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এমনিতেই বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশের শিশুরা ইন্টারনেটের সুবিধা পাচ্ছে না। মূলত ধনী ও সচ্ছল পরিবারের শিশুরা এই সুযোগ সবচেয়ে বেশি পায়। ফলে করোনা সংক্রমণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়টাতে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা চালু হলে তা শিক্ষার ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আরও বাড়তে পারে।
জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বের ৪১০ কোটি মানুষের ৫৬ শতাংশ ইন্টারনেট–সুবিধা পাচ্ছে। এর মধ্যে শিশুদের ইন্টারনেট পাওয়ার সুবিধা সবচেয়ে কম। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও ১ কোটি ২০ লাখ শিশু ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছে না বলে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ফলে ইন্টারনেট ভিত্তিক শিক্ষা সব শিশুর জন্য কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে, তা নিয়েও অনেক বিশেষজ্ঞ সংশয় প্রকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় এমনিতেই মূল ধারা, ধর্মীয় ও ইংরেজি মাধ্যম নামের তিনটি ধারা তৈরি হয়ে আছে। আবার আমাদের শিশুদের বেশির ভাগ এখনো স্কুলে খাবার পায় না। যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে মিড–ডে মিল বা স্কুলে দুপুরের খাবার বাসায় ভাউচারের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশের করোনা মোকাবিলায় যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে শিশুদের বাসায় বসে যাতে তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য–সুবিধা পায়, সেই পরিকল্পনা নিতে হবে।’
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘করোনার কারণে আমাদের অর্থনীতিতে যে ভূমিকম্প আসছে, তার প্রভাবে দেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। ফলে শিক্ষার্থীদের বড় অংশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। যে কারণে এখন থেকে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।’