দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘রক্ষায়’ ছয় মাসের মধ্যে বিকল্প প্রস্তাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে নবগঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। আজ শনিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিকল্প প্রস্তাব দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘দূষিত আবহাওয়া’ তৈরি করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন তিনি।
নবগঠিত সংগঠনটির দাবি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়ন-বৈষম্যের বিরুদ্ধে ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা শিক্ষকদের নিয়ে এই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১১ ও ১২ এপ্রিল আয়োজিত ‘কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই: উচ্চশিক্ষা, নীতিমালা, কাঠামো’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী শিক্ষক কনভেনশনে শিক্ষক প্রতিনিধিদের পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা আমরা প্রায়শই বলে থাকি। এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শত-হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের কথা শোনা যাচ্ছে। এই বরাদ্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য নির্মাণ ও কেনাকাটা। বরাদ্দটা আদৌ শিক্ষার জন্য উপযুক্ত কি না বা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় কি না, তার কোনো রকম বালাই না রেখে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক নির্মাণ ও কেনাকাটার বরাদ্দ এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্নীতি, অপচয়, টেন্ডার-বাণিজ্য চলছে। শিক্ষা-গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি না করে এ ধরনের বরাদ্দ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি দূষিত আবহাওয়া তৈরি করা হয়েছে।’
আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা বা গবেষণার চেয়ে সরকারদলীয় আনুগত্য প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে শিক্ষকতার মান, শিক্ষার্থীদের সুযোগ ও গবেষণার মতো বিষয়গুলো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তাই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গণতান্ত্রিক ও শিক্ষা-গবেষণামুখী নীতিমালা দরকার। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে ভয় পায়। সরকার মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে চিন্তা ও জ্ঞান তৈরি হয়, তাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করে কর্তৃত্বের মধ্যে রাখা না যায়, সেই চিন্তা ও জ্ঞান তাদের পক্ষে না-ও যেতে পারে। এ কারণেই সব সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণের একটি প্রবণতা দেখা যায়। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে উপাচার্যদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়, সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনকে একচেটিয়া ক্ষমতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
নেটওয়ার্কের কনভেনশনে শিক্ষকদের পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনায় উঠে আসা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি সংকটের কথা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। সংকটগুলো হলো সরকারি কর্তৃত্ব, নয়া উদারবাদী নীতি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কৌশলপত্র, স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার, শিক্ষায় বরাদ্দ ও গবেষণা, অস্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়, নিয়োগ ও ভর্তি, শিক্ষার্থীদের আবাসন ও ছাত্ররাজনীতি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ’৭৩-এর অধ্যাদেশের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় একটি গণতান্ত্রিক ও জ্ঞানমুখী পরিচালনা নীতিমালা প্রবর্তনের পক্ষে নেটওয়ার্ক বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত মুনাফামুখী ও মান অর্জনে কম আগ্রহী এবং এগুলোতে গবেষণার পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী অথচ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়ছে।
শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দের বিষয়ে নেটওয়ার্ক বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একদিকে গবেষণার তহবিলের বরাদ্দ নেই, অন্যদিকে দলীয় রাজনীতি গবেষণামনস্ক শিক্ষকদের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। নিয়োগ ও ভর্তির ক্ষেত্রে ভালো ফলের শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে দলীয় বিবেচনায় ‘ভোটার’ নিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করে নেটওয়ার্ক।
এসব সংকট সমাধানে ছয় দফা সমাধান প্রস্তাব উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক। শিক্ষা খাতে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক বিনিয়োগ, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের নীতি থেকে সরে এসে বছর বছর শিক্ষার্থীদের বেতন বৃদ্ধি বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা বিভাজন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পূর্ণকালীন শিক্ষক বাড়ানো ও রাষ্ট্রের মনোযোগ বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া দলীয় ও আঞ্চলিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ ও ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছে সংগঠনটি।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক কাজী মারুফ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সাঈদ ফেরদৌস উপস্থিত ছিলেন।