বান্দরবানে ‘রেংমিটসা’ নামে বিলুপ্তপ্রায় একটি ভাষা খুঁজে পাওয়া গেছে। এই ভাষায় কথা বলা ৩০ জন মানুষেরও সন্ধান মিলেছে। তবে তাঁরা সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে ম্রো ভাষায় কথা বলেন। তাঁদের বংশধরেরাও এই ভাষা জানে না। গবেষকদের আশঙ্কা, এখন পর্যন্ত যে ৩০ জনের খোঁজ মিলেছে, তাঁদের মৃত্যু হলে রেংমিটসা ভাষাও বিলুপ্ত হবে।
ভাষা-গবেষক যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের লিঙ্গুইস্টিকস অ্যান্ড কগনিটিভ সায়েন্সের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসন এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি ১৯৯৯ সাল থেকে বান্দরবানের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গবেষণা করছেন।
ডেভিড এ পিটারসন জানান, ১৬ বছর ধরে খুমি, খিয়াং, বম ও ম্রো আদিবাসী ভাষা নিয়ে কাজ করার সময় তিনি ম্রোদের সঙ্গে মিশে যাওয়া রেংমিটসাভাষীদের খুঁজে পান। তাঁরা নিজেদের ম্রো পরিচয় দিলেও তাঁদের ভাষা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ ভাষার সঙ্গে খুমি ভাষার কিছুটা মিল আছে। ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সী ৩০ জন নারী-পুরুষ ছাড়া এ ভাষা এখন আর কেউ জানে না।
আলীকদমের রেংমিটসাভাষী রেংপুং ম্রো (৬২), কুনরাও ম্রো (৫৬) বলেন, তাঁরা এখন নিজেদের ম্রো পরিচয় দিয়ে থাকেন। রেংমিটসা ভাষার মানুষ সংখ্যায় কম। ম্রোদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকায় তাঁদের ছেলেমেয়েরা এখন কেউ রেংমিটসা ভাষা জানে না। তাঁদের পরিবারের সবাই ম্রো ভাষায় কথা বলে।
পার্বত্য বান্দরবানে সবচেয়ে অনগ্রসর কিন্তু আদিবাসীদের মধ্যে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ম্রো আদিবাসীদের নিয়ে ষাটের দশকে গবেষণা করেছেন জার্মান ভাষাবিদ লরেন্স জি লোফলার এবং ক্লাউস ডিটার ব্রাউনস। আশির দশকে তাঁদের প্রকাশিত দ্য ম্রো গ্রন্থে রেংমিটসা সম্পর্কে লেখা হয়, আরাকান থেকে খুমিদের সঙ্গে ছোট একটি দল বান্দরবানে আসে। তারা ছিল রেংমিটসাভাষী। পরে তারা মাতামুহুরী নদীর উজানের ম্রোদের সঙ্গে প্রায় মিশে যায়।
গত ১১ জানুয়ারি ডেভিড পিটারসন বান্দরবান প্রেসক্লাবে রেংমিটসা ভাষাভাষী চারজন নারী-পুরুষকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নায়রা খানও উপস্থিত ছিলেন।
নায়রা খান জানান, ষাটের দশকে রেংমিটসাভাষীদের প্রথম খুঁজে বের করেন জার্মান ভাষাবিদ লরেন্স জি লোফলার। এরপর এ ভাষা নিয়ে আর খুব একটা কাজ হয়নি। দেড় দশক ধরে মার্কিন গবেষক ডেভিড এ পিটারসন বান্দরবানের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বিপন্নপ্রায় এই ভাষার মানুষকে আবারও খুঁজে বের করেন। এখন পর্যন্ত এই ভাষার যে ৩০ জনকে খুঁজে পাওয়া গেছে, তাঁদের সবার বয়স ৫০-এর ওপর। তবে তাঁরা ভাষাটি জানলেও কথা বলেন ম্রো ভাষায়। সন্তানেরা না শেখায় তাঁদের মৃত্যুর পর ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে ডেভিড বলেন, জার্মান ভাষাবিদ লরেন্স জি লোফলারের একটি নিবন্ধ থেকে প্রথম রেংমিটসা ভাষা সম্পর্কে জানতে পারেন। এর পর থেকে এ নিয়ে গবেষণা করছেন। খুমি ও খিয়াং ভাষায় অভিধান ও ব্যাকরণ লিখেছেন তিনি। এখন ম্রো ও রেংমিটসা ভাষা নিয়ে কাজ করছেন।
ম্রো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস গবেষক সিংয়ং ম্রো বলেন, রেংমিটসা আলাদা ভাষা। এই ভাষাভাষীরা আলাদা জনগোষ্ঠী। সংখ্যায় কম হওয়ায় তারা এখন ম্রোদের সঙ্গে মিশে গেছে। একসময় এই ভাষাভাষীরা নিজেদের রেংমিটসা হিসেবে পরিচয় দিত। সম্ভবত আরাকানে তারা ম্রো-খুমি পরিচয় দিয়ে থাকে এবং সেখানে এ ভাষার আরও লোকজন থাকতে পারে।