করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সেবা দিতে চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে যেসব সরকারি কর্মচারী কাজ করছেন, তাঁদের বিমাসুবিধার পরিবর্তে সরাসরি নগদ অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের গ্রেড এবং আক্রান্ত ও মৃত্যু অনুযায়ী আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে ৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭ এপ্রিল বিভিন্ন জেলার সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, ‘যেসব চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের পুরস্কৃত করতে চাই। তাঁদের একটা সম্মানীও দিতে চাই।’ চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী সরকারি কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সবাইকে বিশেষ বিমা পলিসির আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বিমা পলিসি আর হচ্ছে না। এর বদলে সবাইকে সরাসরি টাকা দেওয়া হবে। আর পুরো বিষয় দেখভাল করবে সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড। সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), জীবন বিমা করপোরেশন এবং সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে। ওই নীতিমালা চূড়ান্ত করার জন্য ১২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পুরো বিষয় উল্টে যায়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এ সময়ে বিমা পলিসি করা কঠিন হবে। কারণ, পলিসি করতে হলে আসবে প্রিমিয়ামের প্রশ্ন। এখন কারও কাছ থেকে প্রিমিয়াম নেওয়া সম্ভব হবে না।
অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাফর ইকবাল, জীবন বিমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজুল হক, আইডিআরএর সদস্য মোশাররফ হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পরদিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, চিকিৎসকদের বিশেষ সম্মানী দিতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। আর দায়িত্ব পালনকারী কেউ আক্রান্ত হলে পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য থাকছে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবিমা এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৫ গুণ বেশি। স্বাস্থ্যবিমা ও জীবনবিমা বাবদ ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আর্থিক সুবিধা দেওয়াসংক্রান্ত একটি সারসংক্ষেপ অনুমোদনের জন্য এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদনের পর তা নীতিমালা আকারে জারি করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রশাসনের কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত অন্যান্য সরকারি কর্মচারী, যাঁরা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরাই এ সুবিধার আওতাভুক্ত থাকবেন। এঁদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তরাই কেবল সুবিধা পাবেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু এটি করোনাভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই বিমাসুবিধার বিষয়টি রাখা হচ্ছে না। তার বদলে সরাসরি টাকা দিয়ে দেওয়া হবে।
এদিকে মন্ত্রণালয়ের করা খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ১৫ থেকে ২০তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন ৫ লাখ টাকা, ১০ম থেকে ১৪তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন সাড়ে ৭ লাখ আর ১ম থেকে ৯ম গ্রেডের আক্রান্ত কর্মচারীরা পাবেন ১০ লাখ টাকা। একইভাবে ১৫ থেকে ২০তম গ্রেডের কেউ মারা গেলে ২৫ লাখ টাকা, ১০ম থেকে ১৪তম গ্রেডের কেউ মারা গেলে সাড়ে ৩৭ লাখ ও ১ম থেকে ৯ম গ্রেডের কেউ মারা গেলে পাবেন ৫০ লাখ টাকা।
তবে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ছাড়া কোয়ারেন্টিনে থাকা বা না থাকা ব্যক্তি এই সুবিধার আওতায় আসবেন না। কোভিড-১৯ ছাড়া অন্য কোনো রোগে মারা যাওয়া ব্যক্তি এ সুবিধা পাবেন না। সরকারি হাসপাতালের বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া কোনো চিকিৎসক, নার্স বা কর্মী আক্রান্ত হলে বা মারা গেলেও সরকারি এ আর্থিক সুবিধা পাবেন না।
তবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সরকার যদি কোনো বেসরকারি হাসপাতালকে করোনার চিকিৎসার জন্য ঠিক করে, তবে ওই হাসপাতালে যাঁরা চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, তাঁদেরও সরকারি সুবিধাভোগীর আওতায় আনা উচিত।
কীভাবে দাবি করতে হবে
আক্রান্ত সরকারি কর্মচারী বা তাঁদের নমিনিদের এ সুবিধার আওতায় অর্থসহায়তা পেতে আবেদন করতে হবে সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডে। এ জন্য লাগবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মনোনীত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়নপত্র। পাশাপাশি লাগবে চিকিৎসার চার্টসহ হাসপাতালে ভর্তির প্রত্যয়নপত্র, হাসপাতালের বিল ও অন্যান্য বিল। আর মারা গেলে অবশ্যই লাগবে মৃত্যুসনদ। নানা প্রমাণপত্র সাপেক্ষেই আক্রান্ত ব্যক্তি বা মৃত ব্যক্তির নমিনিকে টাকা দেওয়া হবে।
এ ছাড়া যে কর্মচারীর পক্ষ থেকে এ সুবিধার জন্য আবেদন করা হবে, তিনি করোনা মোকাবিলায় কীভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, তার সুনির্দিষ্ট বিবরণসংবলিত প্রত্যয়নপত্রও লাগবে। সেখানে তাঁর কাজের ধরন, কোথায়, কীভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানপ্রধান এই প্রত্যয়নপত্র দেবেন।