বিবেকের মতো একজন উদ্যোক্তা

দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা, ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান ২০২০ সালের ১ জুলাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আজ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

লতিফুর রহমান

১৯৭৪ সালে যখন আমরা ফার্মগেটে থাকি, তখন থেকেই জনাব লতিফুর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয়। তাঁকে আমি শামিম আঙ্কেল ডাকতাম। তাঁর দুই সন্তান আরশাদ ওয়ালিউর রহমান আর সিমিন রহমানের সঙ্গে আমি একত্রে স্কুলে পড়েছি। অল্প বয়স থেকেই তাঁদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ইস্তাম্বুল বা প্যারিস—যেখানে যেখানে তাঁরা যেতেন, সে ছবিগুলো আমরা দেখতাম। তবে লতিফুর রহমানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার এবং শেখার সুযোগ হয় এমসিসিআইয়ের (মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি) সূত্রে। তিনি সাতবার এর সভাপতি হয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে এমসিসিআইয়ের মধ্যে ভালো একটি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ গড়ে ওঠে।

এমসিসিআইয়ে আমার হাতেখড়ি হয়েছিল মূলত লতিফুর রহমান এবং তাঁর কাছের বন্ধু জনাব সি কে হায়দারের মাধ্যমে। প্রথমে আমাকে প্রায় জোর করে একটা উপকমিটির সভায় নিয়ে আসা হয়। তাঁর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমার মনে আছে, তিনি আমাকে বকা দিয়ে বলতেন, ‘তুমি চুল কাটো না কেন?’ ‘টাই পরে আসবে।’ এত সুন্দর করে তিনি বকা দিতেন যে বকা বলে মনে হতো না। এটাও ছিল তাঁর অসাধারণ এক গুণ।

তবে সবকিছুর পরও লতিফুর রহমানকে সবাই স্মরণ করবেন বাংলাদেশের একজন ব্যতিক্রমী ব্যবসায়ী হিসেবে। আমি পাঁচটি জায়গায় তাঁর মধ্যে ব্যতিক্রম খুঁজে পাই।

এক. ‘অর্থ’ ও ‘নীতি’ এই দুটি শব্দ পরপর যুক্ত হয়েই তো অর্থনীতি। কিন্তু আমি দেখেছি, লতিফুর রহমানে কাছে ‘নীতি’ শব্দটি আসত আগে, তার পরে ‘অর্থ’। কঠোরভাবে নীতি পালন করেও যে বাংলাদেশে ব্যবসা করে সফল হওয়া যায়, তার অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি থেকে যাবেন।

দুই. অনেক ব্যবসায়ীর মধ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে শর্টকাট খোঁজার একটি প্রবণতা আছে। যে পথটা সঠিক, বাংলাদেশে অনেক সময় সেটা করাই সবচেয়ে বেশি কষ্টকর। অনেকেই তাই শর্টকাট পথ নেওয়ার দিকে সহজেই ঝুঁকে পড়েন। আমরা সবাই দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে চাই না, করতে পারি না। এ ক্ষেত্রে লতিফুর রহমান ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম। স্বল্পমেয়াদি কিছু তিনি চিন্তাই করতে পারতেন না। সে কারণেই সম্ভবত আজ তাঁর প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ মেয়াদে ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে।

তিন. খুব দ্রুত সহজ পথটা নিয়ে নেওয়ার কারণে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অনেক সময় সুবিধাবাদী বলে দুর্নাম করা হয়। লতিফুর রহমান সব সময় কেন যেন কষ্টকর পথটাই অনুসরণ করতেন। যেখানে আপস করলে কাজটা সহজ হয়ে যেত, সেখানে আপস করার কোনো প্রশ্নই উঠত না। এটা যে তিনি অনেক ভেবেচিন্তে করতেন, তা–ও নয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এটা তাঁর ভেতর থেকে আসত। যেটা নীতি বলে মনে হবে, সেটাই যে করতে হবে, এ নিয়ে তাঁর কোনো সংশয়ই ছিল না।

চার. বাংলাদেশ যে শুধু একটি জনসম্পদই নয়, এখানে যে একটা বাজারও আছে—এটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি আমাদের দেখিয়েছিলেন, শুধু রপ্তানি নয়, স্থানীয় বাজারের সম্ভাবনাও এখানে কী বিশাল। অনেকের আগে তিনি এ সম্ভাবনার পথ উন্মোচন করেছেন।

পাঁচ. সফলতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যে অনেক সময় অহংবোধ চলে আসে। লতিফুর রহমান ছিলেন এর ঠিক বিপরীত। তিনি যত বড় হচ্ছিলেন, নম্রতা ও ভদ্রতা যেন ততই আরও বেশি করে তাঁর মধ্যে জেগে উঠছিল। আত্মপ্রচার তাঁর মধ্যে মোটেই ছিল না। শুধু ভাবতেন, প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে আরও বড় করে তুলবেন।

পেশাদারি ও আন্তরিকতার অবিশ্বাস্য সংমিশ্রণ দিয়ে কীভাবে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়, তাঁর খুব কাছে থেকে সেটা আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল আন্তরিকতা। প্রত্যেকটা লোকের নাম তিনি মনে রাখতেন। এমসিসিআইয়ের দরজা যিনি খুলে দিচ্ছেন, যিনি লিফট চালাচ্ছেন বা আপ্যায়ন করছেন, সবার নাম তিনি মনে রাখতেন। এমসিসিআইয়ের কোনো অনুষ্ঠানে এলে পেছনের আসনে গিয়ে বসতেন। তাঁকে জবরদস্তি করে সামনে এনে বসাতে হতো। যাঁর মুখোমুখিই হোন না কেন, তিনিই সবাইকে আগে সালাম দিতেন। অনেক চেষ্টা করেও কখনো তাঁকে প্রথমে সালাম দিতে পারিনি।

কয়েকটি স্মৃতি মনে করতেই হয়। একবার তাঁর অফিসে বসে আলাপ করছি। কুড়কুড়ে তখন মাত্র বাজারে এসেছে। কথায় কথায় তাঁকে বললাম, কুড়কুড়ের একটা ফ্লেভার আমার সন্তানেরা খুব পছন্দ করেছে। এরপর থেকে প্রতিবছর এক কার্টন করে কুড়কুড়ে আমার বাসায় চলে আসত। প্রতিটি ঘটনার খুঁটিনাটি তিনি লক্ষ করতেন। সব তিনি মনে রাখতেন।

আরেকবার ট্রান্সকমের শোরুম থেকে একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন কিনেছিলাম। শোরুমের ম্যানেজারটি দুর্দান্ত ভালো ছিলেন। একদিন এমসিসিআইয়ের একটা বৈঠকের পর তাঁকে বললাম, ‘শামিম আঙ্কেল, আপনার ওই ম্যানেজারটা দারুণ। আপনারা কীভাবে প্রশিক্ষণ দেন?’ পরে শুনতে পেয়েছি, তিনি ফিরে গিয়ে ওই ম্যানেজারকে ফোন করেছেন। সেই ম্যানেজারের তো আত্মহারা হয়ে যাওয়ার কথা যে তাঁর চেয়ারম্যান তাঁকে ফোন করেছেন। এগুলো আমাদের অনুসরণ করার মতো ব্যাপার।

তাঁর জীবনে অনেক দুঃখ, কষ্ট, বাধা এসেছে। কিন্তু কখনো তাঁকে কারও সম্পর্কে খারাপ কথা বলতে শুনিনি। হ্যাঁ, প্রিয় বা অপ্রিয় সত্য কথা বলার জন্য তিনি আমাদের সাহস দিয়েছেন। মেট্রোপলিটন চেম্বারে যা ভালো তার প্রশংসা করেছেন এবং আমাদেরও করতে শিখিয়েছেন।

ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটা বিবেকের মতো।

সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার

(লতিফুর রহমান স্মরণে ১৪ জুলাই ২০২০ তারিখে প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত ‘স্মৃতি ও কৃতি’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সভায় দেওয়া বক্তব্য।)