বিস্ফোরণে উড়ে গেছে কনটেইনারের বিভিন্ন অংশ। ডিপোর সব দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তৈরি পোশাকের বাক্স। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ির বিএম কনটেইনার ডিপোর চিত্র
বিস্ফোরণে উড়ে গেছে কনটেইনারের বিভিন্ন অংশ। ডিপোর সব দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তৈরি পোশাকের বাক্স। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ির বিএম কনটেইনার ডিপোর চিত্র

বিপজ্জনক পণ্য রপ্তানি বন্ধ

শিপিং কোম্পানিগুলো পরিবহন না করায় হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড ও পাটখড়ির ছাই রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে।

  • চট্টগ্রামের বিভিন্ন ডিপোতে আটকা পড়েছে অন্তত ১৬০ কনটেইনার বিপজ্জনক পণ্য।

  • বিএম ডিপোর ঘটনার পর বিপজ্জনক কিছু পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও সংকট তৈরি হয়েছে।

সীতকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের পর রাসায়নিকসহ বিপজ্জনক পণ্য রপ্তানিতে বাধার মুখে পড়ছে বাংলাদেশ। শিপিং কোম্পানিগুলো পরিবহন না করায় হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড ও পাটখড়ির ছাই (চারকোল) রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন ডিপোতে আটকা পড়েছে অন্তত ১৬০ কনটেইনার বিপজ্জনক পণ্য। এর মধ্যে রাসায়নিক ও চারকোল রয়েছে।

রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় ইতিমধ্যে একটি রাসায়নিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চালু থাকা কারখানাগুলোও উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।

শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক, দুর্ঘটনার পর আতঙ্কে রাসায়নিকসহ বিপজ্জনক পণ্য পরিবহন করতে চাচ্ছে না শিপিং কোম্পানিগুলো। রাসায়নিক পণ্য পরিবহনের সময় জাহাজে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে কি না, এমন আতঙ্ক কাজ করছে। যে কারণে সাময়িকভাবে কোনো শিপিং কোম্পানিই বাংলাদেশ থেকে রাসায়নিকের কনটেইনার নিতে চাচ্ছে না।

দেশে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রপ্তানিতে শীর্ষ দুটি প্রতিষ্ঠান হলো টি কে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড ও মেঘনা গ্রুপের তাসনিম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের ইনফিনিয়া কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, ঢাকার এইচপি কেমিক্যালস লিমিটেড ও চট্টগ্রামের আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স এই পণ্য রপ্তানি করে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে এসব প্রতিষ্ঠান ৭২ হাজার ৩৩২ টন হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা এনেছে প্রায় ২৩১ কোটি টাকা। মূলত বস্ত্র খাতে এই রাসায়নিকের ব্যবহার বেশি হয়।

সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোস্তফা হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বিধিবিধান মেনেই ১৪ বছর ধরে আমরা হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রপ্তানি করে আসছি। সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে এই পণ্যটির রপ্তানি বাড়ছিল। এখন শিপিং কোম্পানিগুলো পরিবহন না করায় বন্ধ হয়ে গেছে রপ্তানি। আমরা রপ্তানিমুখী একটি কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।’

এক যুগ আগেও দেশে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড আমদানি করতে হতো। এরপর এই রাসায়নিকের কারখানা গড়ে ওঠায় দেশের চাহিদা মিটিয়ে ২০০৮ সাল থেকে রপ্তানি শুরু হয় পণ্যটি।

৪ জুন সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে আগুন থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।

চট্টগ্রামের বেসরকারি ডিপোগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীতাকুণ্ডে দুর্ঘটনার সময় তিনটি ডিপোতে ১০৭ কনটেইনার হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডের চালান রপ্তানির অপেক্ষায় ছিল। শিপিং কোম্পানিগুলো পরিবহন না করায় সাতটি কনটেইনার ফেরত নিয়েছে বিভিন্ন কারখানা। বাকি ১০০ কনটেইনার থেকে রপ্তানি পণ্য ফেরত নিতে কারখানাগুলোকে বলা হয়েছে।

পাটখড়ির ছাই রপ্তানিও বন্ধ

বাংলাদেশ থেকে পাটখড়ির ছাই বা চারকোল রপ্তানি শুরু হয় ২০১২ সাল থেকে। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি টাকা।

বিএম ডিপোতে দুর্ঘটনার পর চারকোল পরিবহন করতে চাচ্ছে না শিপিং কোম্পানিগুলো। এতে ডিপোগুলোতে ৬০টি কনটেইনার চারকোল আটকা পড়েছে। বিভিন্ন কারখানায় রয়েছে আরও ১০০ কনটেইনারের মতো রপ্তানি পণ্য।

বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মির্জা জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সীতাকুণ্ডের ঘটনার পর শিপিং কোম্পানিগুলো পরিবহন করবে না বলে জানিয়েছে। এতে এই খাতে রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে।

পাটখড়ির ছাইয়ে থাকা কার্বন পাউডার দিয়ে প্রসাধনসামগ্রী, ব্যাটারি, কার্বন পেপার, পানির ফিল্টারের উপাদান, দাঁত পরিষ্কার করার ওষুধ ও ফটোকপি মেশিনের কালি তৈরি করা হয়।

সংকটে আমদানিও

বিএম ডিপোর ঘটনার পর বিপজ্জনক কিছু পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও সংকট তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত রোববার জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুর রাজ্জাক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, শিপিং লাইনগুলো বন্দরে খালাসের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার অজুহাত দেখিয়ে বিপজ্জনক পণ্য পরিবহন করছে না। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।

তবে বন্দর দিয়ে বিপজ্জনক পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই বলে জানান চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিপজ্জনক পণ্য পরিবহনে প্যাকেজিং ও কনটেইনারে মার্কিং করাসহ আন্তর্জাতিক বিধিবিধান মেনে পরিবহন করতে হবে।

আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা প্রণীত ‘ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস বা আইএমডিজি কোড’ অনুযায়ী বিপজ্জনক পণ্যের মধ্যে রয়েছে দাহ্য তরল ও কঠিন পদার্থ, বিষাক্ত ও তেজস্ক্রিয় পদার্থ, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, শিল্পের কাঁচামাল, চারকোল, বিস্ফোরক পদার্থ ইত্যাদি।

সীতাকুণ্ডের ঘটনার পর কিছু রপ্তানি পণ্য পরিবহনে সমস্যা তৈরি হওয়ার বিষয়ে নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ, প্যাকেটজাত করা ও পরিবহন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিধিবিধান কঠোরভাবে মেনে চলার বিষয়ে এখন আরও মনোযোগী হতে হবে।

একই সঙ্গে যেসব সংস্থা বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম তদারকি করছে, তাদের সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে একটি সমন্বিত নীতিমালা করা দরকার। এই নীতিমালা মেনে চললে সামনে সমস্যা আর হবে না।