কনটেইনার ডিপোতে রাসায়নিকের মতো বিপজ্জনক পণ্য আলাদাভাবে সংরক্ষণ করার কথা। আবার প্রশিক্ষিত কর্মী দিয়ে এসব পণ্যের ব্যবস্থাপনার বাধ্যবাধকতা আছে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে এমন বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না।
এ পরিস্থিতিতে প্রায় পাঁচ বছর আগে কনভেনশন অনুযায়ী বিধিবিধানগুলো মানা হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের সুপারিশ করেছিল আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা। সেই কর্তৃপক্ষও গঠন করা হয়নি।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর এই বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় গতকাল সোমবার পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ ৪১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক।
তবে শুধু বিএম ডিপোই নয়, চট্টগ্রামের বেসরকারি আরও ১৮টি ডিপো এবং বন্দরগুলোতে বিপজ্জনক পণ্য সুরক্ষা মেনে ওঠানো–নামানো, পরিবহন ও সংরক্ষণের যথাযথ তদারকি হচ্ছে না। দ্রুত তদারকি কর্তৃপক্ষ গঠন করা না হলে সামনে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ কঠিন হবে বলে জানিয়েছেন এ খাতের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা।
বিপজ্জনক পণ্য সম্পর্কিত বিধিবিধান অনেক কিছু মানা হয় ডিপোতে। কনটেইনারে লেবেল বা মার্কিং দেওয়া হয়। মার্কিং দেওয়া না হলে তা বন্দরই আটকে দেবে।নুরূল কাইয়ূম খান, বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সমিতির সভাপতি
দেশে রাসায়নিকের মতো বিপজ্জনক পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে। যেমন চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে শুধু হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রপ্তানি হয়েছে ৭ কোটি ২৩ লাখ কেজি। দেশের রপ্তানি পণ্যের ৮০ শতাংশই চট্টগ্রামের বেসরকারি ডিপোগুলোতে সংরক্ষণ, কনটেইনারে বোঝাই ও ওঠানো–নামানো হয়। এরপর ডিপো থেকে গাড়িতে করে বন্দরে নিয়ে জাহাজে তুলে দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামের দুটি বেসরকারি ডিপোর দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, রপ্তানি বাড়লেও বিপজ্জনক পণ্য সংরক্ষণের মতো ব্যবস্থা সব ডিপোতে নেই। তাতে ঝুঁকি রয়ে যায়।
জানতে চাইলে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো সমিতির সভাপতি নুরূল কাইয়ূম খান প্রথম আলোকে বলেন, বিপজ্জনক পণ্য সম্পর্কিত বিধিবিধান অনেক কিছু মানা হয় ডিপোতে। কনটেইনারে লেবেল বা মার্কিং দেওয়া হয়। মার্কিং দেওয়া না হলে তা বন্দরই আটকে দেবে। তবে এটা ঠিক, আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী দেশে একটি পরিপূর্ণ নীতিমালা করা উচিত—কারা বিপজ্জনক পণ্য পরিবহন করতে পারবে; যারা করবে, তাদের কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে ইত্যাদি।
বিপজ্জনক পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা প্রণীত ‘ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস বা আইএমডিজি কোড’ আছে। সাগরে জীবনের নিরাপত্তাবিষয়ক সোলাস (সেফটি অব লাইফ অ্যাট সি) কনভেনশনের আওতায় এ কোড রয়েছে। এ কনভেনশনে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে। ২০০৪ সাল থেকে এ কোডের নিয়মকানুন মানা বাধ্যতামূলক। এ কোডের আওতায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয় ২০১০ সাল থেকে।
এ কোডের আওতায় নয়টি ক্যাটাগরির পণ্যের একটি তালিকা রয়েছে। তাতে রাসায়নিক, বিস্ফোরক, বিপজ্জনক গ্যাস, দাহ্য তরল ও কঠিন পদার্থ, বিষাক্ত, তেজস্ক্রিয়, জারণ পদার্থসহ বিপুলসংখ্যক পণ্য রয়েছে। সাধারণত অন্য পদার্থের সংস্পর্শে এলে এসব পণ্য স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির কারণ হতে পারে। সে জন্য এসব পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে সংরক্ষণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তার নীতিমালা আছে আইএমডিজি কোডে।
যদিও বাংলাদেশে আইএমডিজি কোডের নীতিমালা বাস্তবায়নে ঘাটতির কথা তুলে ধরেছে আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা। ২০১৭ সালে সংস্থার নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ কোডসহ নৌ খাতের ১৭টি বিষয়ে ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়। ঘাটতি তদারকির জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে ‘কম্পিটেন্ট অথরিটি’ বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়। নৌপরিবহন অধিদপ্তরও বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানায়। কিন্তু এমন কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়নি বলে জানা গেছে।
যোগাযোগ করা হলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী কনটেইনার ডিপো ও বন্দরগুলো কমপ্লায়েন্স মেনে চলছে কি না, তা তদারক করছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। এটা তাদের রুটিন কাজ। সে কাজ তারা করছে। তবে ‘কম্পিটেন্ট অথরিটি’ গঠনের বিষয়ে মন্ত্রী কিছু বলেননি।
আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার বিধিবিধান বিষয়ে অভিজ্ঞ দুজন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলোর। নাম প্রকাশ না করে তাঁরা জানান, দেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের স্বার্থে এ কোড বাস্তবায়ন করা উচিত।
গত শনিবার রাতে বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণের আগে রাসায়নিকের কনটেইনার ঠিক কী অবস্থায় ছিল, তা জানা যায়নি। ওই ডিপোতে ওয়ান শিপিং কোম্পানির কনটেইনার ছিল। ওই কোম্পানির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, রাসায়নিকবাহী প্রতিটি কনটেইনারের পাঁচটি জায়গায় বিপজ্জনক পণ্যের লেবেল (ডিজি স্টিকার) ছিল। ২০২১ সালের ২৩ জুন বন্দরের এক আদেশে বলা হয়, এ স্টিকার না থাকলে জাহাজীকরণ করা হবে না। আবার স্টিকার ছাড়া কনটেইনার অন্য দেশের বন্দরে নেওয়া হলে জরিমানার মুখে পড়তে হয়।
তবে স্টিকার থাকলেও কনটেইনার ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী দরকার। কিন্তু বিএম ডিপোর কর্মী বা পরিবহনশ্রমিকেরা প্রশিক্ষিত কি না, সেটি জানা যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএম কনটেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান প্রথম আলোর কাছে লিখিত বার্তায় দাবি করেন, ডিপোতে সব বিধিবিধান অনুসরণ করে রাসায়নিক পণ্য সংরক্ষণ ও ওঠানো–নামানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক কনভেনশন ছাড়াও দেশে বিপজ্জনক পণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য দেশে যুগোপযোগী আইন নেই। ১৯৫৩ সালে প্রণীত ডেঞ্জারাস কার্গো অ্যাক্টে যা রয়েছে, তা বর্তমান চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কারণ, আমদানি–রপ্তানিতে নতুন নতুন বিপজ্জনক পণ্য যোগ হচ্ছে।
২০২১ সালের ২ জুন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভা থেকে এ আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়। এর আগে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অথরিটি ফর কেমিক্যাল উইপেন কনভেনশনের একটি বিশেষজ্ঞ দল এ আইন সংশোধনের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু এরপর আর কোনো অগ্রগতির কথা জানা যায়নি।