আগামী শিক্ষাবর্ষে সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের (মাদ্রাসা, কারিগরিসহ) সোয়া ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে প্রায় ৩৫ কোটি ৪০ লাখ বই দিতে এখন জোরেশোরে প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। শিক্ষার্থীর এই সংখ্যা বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি।
শুধু এবারই নয়, ২০১০ সাল থেকে শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন ঘটা করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দিচ্ছে সরকার। খালি হাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে নতুন বই হাতে নিয়ে খুশি হয়ে বাড়ি ফেরে শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে বছরের শুরুর দিন দেশজুড়ে চলে উৎসবের আমেজ।
এনসিটিবির সূত্রমতে, আসন্ন শিক্ষাবর্ষসহ (২০২০ সাল) ১১ বছরে মোট ৩৩১ কোটি ৪৭ লাখ ৮৩ হাজারের কিছু বেশি বই দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। বই দিতে এখন প্রতিবছর সরকারের খরচ হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। শুধু আগামী বছরের জন্য খরচ হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির কর্মকর্তা এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিনা মূল্যে বই দেওয়ার ক্ষেত্রে এটি সারা বিশ্বে বিরল ঘটনা। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিকবার বলেছেন, তিনি যখন ইউনেসকোসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যেতেন, তখন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বিনা মূল্যে এত বিপুল পরিমাণ বই বিতরণের তথ্য শুনে অবাক হতেন এবং তাঁরা বলতেন, বিনা মূল্যে এত বই আর কোথাও দেওয়া হয় না।
সবাইকে একসঙ্গে বিনা মূল্যে বই দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য যেমন কমছে, তেমনি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। আবার ঝরে পড়াও কমছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক—দুই স্তরে বিনা মূল্যের বই দেওয়া শুরুর ১১ বছরের মাথায় দেড় কোটির বেশি শিক্ষার্থী বেড়েছে। তবে বিনা মূল্যে বই দেওয়ার পাশাপাশি উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিং এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরিও শিক্ষার্থী বৃদ্ধির কারণ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে প্রাথমিক স্তরে অর্ধেক বই বিনা মূল্যে দেওয়া হতো। বাকি বই কিনে পড়তে হতো। আর মাধ্যমিক স্তরে সব বই কিনতে হতো। তখন শিক্ষার্থীদের বই পেতেই বছরের কয়েক মাস চলে যেত। অনেকে সামর্থ্যের অভাবে কিনতেও পারত না। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হতো। ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সব শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে নতুন পাঠ্যবই দেওয়া শুরু করে সরকার। এখন প্রাক্-প্রাথমিক ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর (৫টি ভাষায় রচিত তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত) শিক্ষার্থীদেরও বিনা মূল্যে বই দেওয়া হচ্ছে। কখনো কখনো বইয়ের মান এবং বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি সংগঠনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ ধারার বইয়ের বিষয়বস্তু পরিবর্তন নিয়ে আন্দোলন ও সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই বছরের শুরুতে বিনা মূল্যে শিক্ষার্থীদের বই দেওয়া হয়েছে।
বিনা মূল্যে বই দেওয়ার কাজটি করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন এনসিটিবি। বিনা মূল্যে বই দেওয়ার অনন্য কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক স্বাধীনতা পদক পেতে আবেদন করেছে।
>
- আসছে শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের প্রায় ৩৫ কোটি ৪০ লাখ বই দিতে প্রস্তুতি
- শিক্ষার্থী বাড়ছে, ঝরে পড়াও কমছে
সংস্থাটির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিনা মূল্যে বই দেওয়ার আগে দেখা যেত, অসংখ্য শিক্ষার্থী ঝরে যাচ্ছে। আবার কখনো কখনো সব শিক্ষার্থীর বই পেতে জুন পর্যন্তও সময় লেগে যেত। কিন্তু বিনা মূল্যে বই দেওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য কমে গেছে। ঝরে পড়াও কমছে (এখন প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৮ শতাংশ ও মাধ্যমিকে ৪০ শতাংশের কম)। আরেকটি বিষয় হলো, আগে দেখা যেত, শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হতেই এক–দুই মাস চলে যেত। এখন বছরের শুরুতেই শ্রেণি কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হচ্ছে। ইতিবাচক এই পরিবর্তনের বড় কারণ বিনা মূল্যে বই দেওয়া। তিনি দাবি করেন, শিক্ষার্থীরা যাতে আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারে, সেই কথা বিবেচনা করে শিক্ষাক্রমে নতুন করে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, বিনা মূল্যে বই দেওয়ার শুরুর বছর ২০১০ সালে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসার ইবতেদায়ি, দাখিল, দাখিল (ভোকেশনাল), এসএসসি (ভোকেশনাল) স্তরে মোট শিক্ষার্থী ছিল ২ কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৫২৯ জন। তখন তাদের জন্য ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬১টি বই ছাপানো হয়। এরপর দু-এক বছর ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিবছরই শিক্ষার্থী ও বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে।
বিনা মূল্যে বই ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে আগামী শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ২৭ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৩৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৭ কপি বই ছাপানো হচ্ছে। তবে এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, বইয়ের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া চাহিদার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যার হিসাব করা হয়। তাই প্রকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ শতাংশের মতো কমও হতে পারে।
প্রায় সাড়ে ৩৫ কোটি বই ছাপার বিরাট কর্মযজ্ঞের কথা জানিয়ে এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে প্রায় ২৪ কোটি বই ছাপা শেষে উপজেলা পর্যায়ে চলে গেছে। বাকি বইও নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই চলে যাবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, এখন দেশে শিক্ষায় যেটুকু অর্জনের জায়গা আছে, তার একটি হলো বছরের প্রথম দিনে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীর হাতে সব বই বিনা মূল্যে তুলে দেওয়া। বইয়ের মান ও বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, এমনকি পঠন-পাঠন নিয়েও কথা থাকতে পারে। কিন্তু বিনা মূল্যে বই দেওয়ার কারণে যে বিরাট উপকার হচ্ছে, এটা সর্বজনস্বীকৃত। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই খুশি।