বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় বারবার কাঁচি

প্রথমে গ্যাস থেকে সরে কয়লায়। এখন কয়লা থেকে সরে এলএনজি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাওয়ার চিন্তা করছে সরকার।

ম তামিম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী

বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা বারবার বদল করতে হচ্ছে। কারণ, প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি। উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়লেও সরবরাহ, বিতরণের সক্ষমতা বাড়েনি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানির পাশাপাশি নতুন অর্থায়ন মিলছে না। চুক্তি করেও কাজ এগোতে পারছে না কোনো কোনো কেন্দ্রের। বাতিল করা হচ্ছে প্রকল্প। কাগজের পরিকল্পনা এখন বাস্তবে মিলছে না। এ অবস্থায় আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন পরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। পরিকল্পনা বাস্তবানুগ করতে ইতিমধ্যেই তারা পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে। জাইকা তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, কার্বন নিঃসরণ কমানো বা শূন্যে নামিয়ে আনাই হবে নতুন মহাপরিকল্পনার লক্ষ্য। আর এবার শুধু বিদ্যুৎ নয়, মহাপরিকল্পনায় জ্বালানি খাতকেও যুক্ত করা হচ্ছে।

বারবার সংশোধন না করে এখন সর্বোচ্চ পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। এর সঙ্গে স্বল্প মেয়াদে দুই বছর ও দীর্ঘ মেয়াদে ১০ বছরের পরিকল্পনা রাখা যেতে পারে।
ম তামিম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, আগে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমন্বিত মহাপরিকল্পনা করা হবে। এতে উৎপাদনের আগের ও পরের ধাপ বিস্তারিত থাকবে। আগের ধাপে থাকবে উৎপাদনে জ্বালানির উৎস, পরের ধাপে থাকবে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য বলছে, কয়লা থেকে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরে ২০১০ সালে মহাপরিকল্পনা করা হয়। এটি ছিল ৩০ শতাংশ স্থানীয় ও ২০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। আমদানি করা এলএনজিসহ গ্যাস থেকে ২৫ শতাংশ, তরল জ্বালানি থেকে ৫ শতাংশ এবং আমদানি, নবায়নযোগ্য ও পারমাণবিক থেকে আসবে বাকি ২০ শতাংশ। বাস্তবে এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হয়নি।

ফলে ২০১৬ সালে সংশোধন করা হয় মহাপরিকল্পনা। কয়লা বিদ্যুৎ ৫০ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়; যার ৩৪ শতাংশই আমদানিনির্ভর। গ্যাস আমদানি বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয় গ্যাস বিদ্যুৎ। আর আমদানি, নবায়নযোগ্য ও পারমাণবিক উৎস থেকে ধরা হয় ৩০ শতাংশ। এটিও বাস্তবে সম্ভব হয়নি। বর্তমানে গ্যাস থেকে ৫২ শতাংশ, ফার্নেস অয়েলে ২৭ শতাংশ, ডিজেলে ৬ শতাংশ, কয়লায় ৮ শতাংশ, হাইড্রো ও সৌর থেকে ১ শতাংশ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। বাকি ৫ শতাংশ বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৫ সালে করা বিদ্যুৎ খাতের প্রথম মহাপরিকল্পনা ছিল গ্যাসনির্ভর। মাত্র দুই বছরের মাথায় দেশে গ্যাসসংকট দেখা দিলে তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এরপর সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২০১০ সালে দেশীয় কয়লার ওপর ভর করা হয়। তখন পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ২০১২ সালে দেশীয় কয়লা উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে আবার হোঁচট খায় মহাপরিকল্পনা। এবার আমদানিনির্ভর কয়লার ওপর ভর করা হয়। কিন্তু কয়লা আমদানির অবকাঠামো নিয়ে সংকট তৈরি হয়। প্রকল্পে অর্থায়ন পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত গত ২৭ জুন ১০টি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করে দেয় সরকার।

নতুন আস্থা নবায়নযোগ্য জ্বালানি

নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৮৬ গিগাওয়াট থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫০ গিগাওয়াটে নিতে চায় ভারত। ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিটি রাজ্যে ৮ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ করতে চায় তারা। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন উৎসাহী করতে ভর্তুকিও দেওয়া হচ্ছে।

২০২০ সালে মোট উৎপাদনের ৪২ শতাংশ নবায়নযোগ্য থেকে এসেছে যুক্তরাজ্যে। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৬৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য। এর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে সরকার। প্রযুক্তির উন্নয়ন করা হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৬৫ শতাংশ ও ২০৫০ সালের মধ্যে ৮০ থেকে ৯৫ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে নিতে চায় জার্মানি।

বাংলাদেশে কী হচ্ছে? সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিদেশি বিনিয়োগের অনেক প্রস্তাব থাকলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তাদের হিসাবে ৩৬টি প্রকল্পের মধ্যে আটটি বাস্তবায়ন হয়েছে। বড় প্রকল্প নিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) ক্ষমতায়ন দরকার। দেশে এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৩ শতাংশের কম। তবে ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আনার পরিকল্পনা করছে সরকার।

আরেক আস্থা এলএনজি

গ্যাস থেকে সরে কয়লা বিদ্যুতে ঝুঁকেছিল সরকার। এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির পাশাপাশি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দিকেও ঝুঁকছে। কয়লা ও এলএনজি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছে পাওয়ার সেল। এতে বলা হয়েছে, আমদানি করা কয়লায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৭ টাকা ৭৮ পয়সা খরচ পড়ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে। আর দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে মিশ্রণ করে এলএনজি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে ইউনিটে খরচ হবে ৫ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে ৬ টাকা ২০ পয়সার মধ্যে। এলএনজির চেয়ে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৫ গুণ বেশি জমি লাগে। এলএনজি পরিবেশবান্ধব। এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপন, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম। বর্তমানে সরকার ও বেসরকারি খাতে ১২ হাজার ১৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১০টি এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রক্রিয়াধীন আছে।

বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ইমরান করিম প্রথম আলোকে বলেন, সব মিলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই হতে পারে ভরসার জায়গা। বেশি ঘনবসতির কারণেই দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে খুব একটা এগোনোর সম্ভাবনা নেই। সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে তেমন টেকসই হবে না। তবে নেপাল থেকে পানিবিদ্যুৎ আমদানি করা যেতে পারে।

প্রক্ষেপণ আর চাহিদার ফারাক

বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা বিশ্লেষণ করে সিপিডি বলছে, বিনিয়োগ সম্ভাবনা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে তৈরি করা চাহিদার প্রক্ষেপণে ভুল ছিল। এটি পর্যালোচনা করা দরকার। কোনো বছরেই এ প্রক্ষেপণ মেলেনি। ২০১০-১১ সালে প্রক্ষেপণের চেয়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ কম পাওয়া গেছে প্রকৃত চাহিদা। আর সবশেষ ২০২০-২১ সালে এটি ছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ কম। মাঝের বছরগুলোতেও গড়ে ৩০ শতাংশ করে ঘাটতি ছিল। বর্তমান পরিকল্পনায় এগোলে ২০২৫ সালেও ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বসে থাকবে। ১১ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা বসিয়ে রাখা পিডিবির জন্য বড় বোঝা হবে।

এ বিষয়ে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটি খাত না এগোলে তার প্রভাব অন্যটিতেও পড়ে। দেশে পূর্বাভাস অনুসারে বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও বাড়েনি। তাই বিদ্যুতের চাহিদার প্রক্ষেপণ মেলেনি। প্রক্ষেপণের পাশাপাশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারলে পার্থক্য কমে আসবে।

স্বল্প মেয়াদে পরিকল্পনা দরকার

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তি বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। জ্বালানির ধরনও বদলে যাচ্ছে। তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় আটকে থাকার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় স্বল্প মেয়াদে চাহিদা নিরূপণ অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের আস্থা তৈরি করা দরকার।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, বারবার সংশোধন না করে এখন সর্বোচ্চ পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। এর সঙ্গে স্বল্প মেয়াদে দুই বছর ও দীর্ঘ মেয়াদে ১০ বছরের পরিকল্পনা রাখা যেতে পারে। তাহলে পরিকল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে ঘাটতি কমে আসবে। চাহিদা ও সরবরাহ নজরদারির জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স রাখা যেতে পারে।