>
- স্কুলটির প্রধান শিক্ষক তানজিনা নাজনীন ‘মহানুভবতার দেয়াল’ নামের ব্যতিক্রমী এই কার্যক্রম চালু করেছেন।
- দেয়ালের এক পাশে লেখা, ‘তোমার যা প্রয়োজন নেই তা এখানে রেখে যাও’
- অন্য পাশে লেখা, ‘তোমার দরকারি জিনিস পেলে নিয়ে যাও।
আধা পাকা স্কুলভবন! ভেতরে ঢুকতেই ছোট্ট বারান্দা। দেয়ালে প্লাস্টিকের হ্যাঙ্গার সাঁটানো। তার ওপর লেখা, ‘মহানুভবতার দেয়াল’। তার এক পাশে লেখা, ‘তোমার যা প্রয়োজন নেই তা এখানে রেখে যাও।’ আর অন্য পাশে লেখা, ‘তোমার দরকারি জিনিস পেলে নিয়ে যাও।’
শিক্ষার্থীরা তাদের পুরোনো কাপড় এনে হ্যাঙ্গারগুলোতে ঝুলিয়ে দেয়। আর অন্যরা সেখান থেকে কাপড় নিয়ে যায়। পুরোনো কাপড় নেওয়ার জন্য কখনো কখনো বাচ্চাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। এ চিত্র কিশোরগঞ্জ সদরের দক্ষিণ মকসুদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক তানজিনা নাজনীন ‘মহানুভবতার দেয়াল’ নামের ব্যতিক্রমী এই কার্যক্রম চালু করেছেন।
‘শুরুতে কিছু শিক্ষার্থী বিষয়টিকে ভালোভাবে নেয়নি। কেউ পুরোনো কাপড় নিলে বলত, তুমি গরিব, তাই পুরোনো কাপড় নিয়েছ। তখন তাদের বলা হয়, এ দেয়ালের কোনো জিনিস যদি শিক্ষকদের প্রয়োজন হয়, তাঁরাও তা নেবেন। এতে লজ্জার কিছু নেই। একজন, দুজন করে তখন নেওয়া শুরু করে। এখন কেউ নতুন স্কুল ড্রেস বানালে আগের ড্রেসটি এখানে রেখে যায়। তারই কোনো বন্ধু তা নিয়ে ধুয়ে বা একটু সেলাই করে পরে আসে। অভিভাবকেরাও কিছু মনে করছেন না।’ বলছিলেন তানজিনা নাজনীন।
স্কুলটির অনুকরণীয় উদাহরণ আরও আছে। একাধিক অভিভাবক বললেন, প্রধান শিক্ষক শুধু পড়াশোনা না, বাচ্চাদের হাতের নখ বড় থাকলে নিজেই কেটে দেন। কোনো মা টিফিন দিলেন না তাও খেয়াল করেন। দু–এক দিন বাচ্চা স্কুলে না গেলেই প্রধান শিক্ষক বাড়ি এসে হাজির হন। যে বাচ্চারা পড়াশোনায় ভালো সেই মায়েদের কথা উল্লেখ করে বলতে থাকেন, দেখেন ওই যে মুন্নার মা, বাচ্চার জন্য কত কষ্ট করছেন। আর কোনো বাড়ির উঠানে মা সমাবেশে বসে কার কী সমস্যা তা শুনে সমাধানের চেষ্টা করেন। বাচ্চারা পড়তে না চাইলে বাচ্চাদের নিয়ে বিলে শাপলা ফুল তুলতে চলে যান প্রধান শিক্ষক। বাচ্চারা হইহই করতে করতে তাঁর পিছু নেয়। নয়তো বাচ্চাদের নিয়ে কাগজ কেটে ফুল, পাখি বানাতে বসে যান। তারপর বাচ্চাদের আর পড়ার কথা বলতে হয় না, নিজে থেকেই পড়া শুরু করে।
গত ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর স্কুলটিতে গিয়ে দেখা গেল, চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহবুব আলম বাড়ি থেকে কিছু কাপড় এনেছে। কাপড়গুলো হ্যাঙ্গারে ঝোলানো শেষ হওয়ার আগেই চারপাশ থেকে শিক্ষার্থীরা বলতে শুরু করল, ‘ম্যাডাম, এইটা আমার লাগব। ম্যাডাম, ওইটা কিন্তু আমারে দেওন লাগব। আমি কিন্তু আগে বলছি।’
স্কুলের কাছেই নাজমা বেগমের টিনের ঝকঝকে বাড়ি। অবস্থাসম্পন্ন পরিবার। নাজমা বেগমের ছেলে ওই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। স্কুলের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এইটা খুবই ভালো উদ্যোগ হইছে। আমার ছেলেও সেই দিন একটা গেঞ্জি পছন্দ কইরা নিয়া আইছে। আমি কিছু মনে করি নাই।’
তানজিনা নাজনীন জানালেন, বছরখানেক আগে স্কুলটিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। চলতি বছরের ৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মহানুভবতার দেয়াল’–এর উদ্বোধন করেন। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, তিনি কিশোরগঞ্জেরই মেয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগ থেকে এমএসএস করেছেন। ভালো বেতনের চাকরি ফেলে এখানে যোগদান করার জন্য পরিবার থেকে নানা কথা শুনতে হয়েছে। তবু তিনি পিছপা হননি।
স্কুলটি নিয়ে কথা হয় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বললেন, এ ধরনের ‘মহানুভবতার দেয়াল’ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা তৈরি করছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেই জেলার অন্যান্য স্কুলকেও এ ধরনের উদ্যোগ নিতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
দক্ষিণ মকসুদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯৭০ সালে যাত্রা শুরু করে। স্কুলে ছাত্রছাত্রী ১৬৫ জন। আর প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষক আছেন চারজন। আয়া বা দপ্তরি নেই স্কুলটিতে। তানজিনা নাজনীন বলেন, স্কুলের তালা খোলা, ঝাড়ু দেওয়া থেকে শুরু করে সব কাজই করতে হয় তাঁদের। শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীরাও এসব কাজে হাত লাগায়।