স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগ থেকেই এ সংস্থাটি সবার নজর কাড়ে। করোনায় এ সংস্থার কাজ বিভিন্ন সময়ই গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। কিশোর কুমার দাস লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে থাকেন। অল্প কিছু দিনের জন্য গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রসঙ্গে কথা বলেছেন কিশোর। কেরানীগঞ্জে বিদ্যানন্দের ‘মেগা কিচেনে’ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মানসুরা হোসাইন
প্রথম আলো: আট বছরে পা দেওয়া বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন...
কিশোর কুমার দাস: আমরা সফল না বিফল—সেভাবে কখনো মূল্যায়ন করিনি। এক টাকাও নিজেদের না, মানুষের টাকা ও অনুদানে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, সে হিসেবে বিদ্যানন্দকে সফল বলা যায়। বিদ্যানন্দের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে, সেভাবেও বলা যায়। কাজী ফার্মস প্রতিদিন এক হাজার করে ডিম দিয়ে যাচ্ছে। তারা এ পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি টাকার ডিম দিয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান হয়তো চাল দিচ্ছে। করোনাকালে আমরা কোটি কোটি টাকার ত্রাণ বিতরণ করছি। আমাদের মধ্যে কোনো অহংকারবোধ কাজ করেনি, আমরা আগের মতো স্বাভাবিক মানুষই তো আছি।
প্রথম আলো: সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাসহায়তা দিতে শুরু হওয়া বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সারা দেশে এখন ১২টি শাখা। বিদ্যানন্দের প্রায় প্রতিটি কাজেই থাকে নতুনত্ব বা চমক। এ বিষয়ে যদি কিছু বলেন।
কিশোর কুমার দাস: অদল-বদল স্টোর, এক কড়াইতে চার হাজার জনের রান্না, ভাসমান মানুষের হোটেল, এক টাকায় আহার, এক টাকায় চিকিৎসা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পোশাক, শিক্ষা উপকরণ, মাসিক বৃত্তি দেওয়া, ছয়টি এতিমখানা, মা ও শিশু হাসপাতাল পরিচালনা, আইনি সেবা, বিদ্যানন্দ অনাথালয়, ঢাকায় নারীদের জন্য আবাসিক হোটেল, বাসন্তী গার্মেন্টস, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানানোসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিদ্যানন্দ। স্বেচ্ছাসেবকেরা কখনো বসে থাকেন না, এক দিনের কাজ শেষ হলেই নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নামেন তাঁরা।
সম্প্রতি একসঙ্গে চার হাজার জনের রান্নার জন্য কড়াই বানিয়েছি (মেগা কিচেন)। আমরা যে কড়াই বানিয়েছি, তার এক পাশ থেকে আরেক পাশের ব্যাস ৮ দশমিক ৬ ফুট, ওজন এক টন। এটি বানাতে সব মিলে খরচ হয়েছে দুই লাখ টাকা। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো, হাজার হাজার মানুষের রান্নার কাজটাকে সহজ করা। একইভাবে অদল-বদল স্টোর পরিচালনায় খরচ একদম কম। এ স্টোরে একদল মানুষ পণ্য দিচ্ছেন আবার অন্য দল তা নিচ্ছেন। ‘ইনোভেশন’ (উদ্ভাবনে নতুনত্ব) বেশি থাকলে তাতে টাকা কম খরচ হয়। আমরা সবকিছুতে ভ্যালু (মূল্যবোধ ও নতুনত্ব) যোগ করার চেষ্টা করি। অসচ্ছল মানুষকে খাবার দেওয়ার বিষয়টি চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। আমরা খাবার দেওয়ার পাশাপাশি খাবারের দাম হিসেবে এক টাকা রাখছি। এখন অনেকেই বলে এ উদ্যোগ তাদের, আমরা কিছু বলি না, শুধু হাসি।
প্রথম আলো: বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
কিশোর কুমার দাস: বিদ্যানন্দ আবেগনির্ভর প্রতিষ্ঠান নয়, এটিকে মেধানির্ভর করার চেষ্টা চলে সব সময়। স্বেচ্ছাসেবক বা জনবল কত, তার হিসাব রাখি না। তবে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতার জন্য আর্থিক হিসাব-নিকাশে কোনো ফাঁক রাখা হয় না। প্রতিদিন কোনো না কোনো কাজ করছেন, সে ধরনের ৩০০ জনের মতো স্বেচ্ছাসেবক আছেন। আমাদের এখানে যে কেউ চাইলেই স্বেচ্ছাসেবক হতে পারেন না, তাঁকে এক বছর কাজ করে দেখাতে হয় যে তিনি আসলেই কাজ করতে চাইছেন। এখানে স্বেচ্ছাসেবকদের পেশাদার হতে হয় আর কাজটি করতে হয় বিনা পারিশ্রমিকে। স্বেচ্ছাসেবকদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবী। ৩০ জনের খাবার রান্না দিয়ে শুরু হয়েছিল এক টাকার আহার, তা ১০০ থেকে ৫০০ জন, ৫০০ জন থেকে এখন হাজার হাজার মানুষের রান্না। সবই করছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ ভাগ করা থাকে। কেউ হাত গুটিয়ে বসে থাকেন না। তাই এখন আর কোনো আয়োজনকেই বিশাল আয়োজন বলে মনে হয় না।
কোনো স্বেচ্ছাসেবকের টাকা থাকলেও তিনি তাঁর ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারেন না। স্বেচ্ছাসেবকদের কেউ চাইলেই আগে খেতে পারেন না, সবাইকে একসঙ্গে খাওয়া শুরু করতে হয়। খাবার শেষ হলেও কেউ চাইলেও উঠে যেতে পারবেন না। আমাদের এখানে বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। কেউ সেলফি তুলতে পারবেন না। মুঠোফোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত। ছেলে ও মেয়েরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিদ্যানন্দের কাজ প্রগতিশীল, তবে আমাদের আচরণ থাকে রক্ষণশীল। যৌন নির্যাতনসহ স্বেচ্ছাসেবকের ব্যক্তিগত কোনো খারাপ আচরণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হয় না। কেউ নিয়ম মেনে চলতে না চাইলে তাঁকে কাজ না দিয়ে বসিয়ে রাখার শাস্তিও দেওয়া হয়। কেউ যেকোনো সময় কাজ করবেন না বলে চলে যেতে পারেন। তবে বিদ্যানন্দের সঙ্গে থাকতে হলে বেশ কিছু কঠোর নিয়ম মানতেই হবে।
প্রথম আলো: বিদ্যানন্দকে জবাবদিহি করতে হয় কার কাছে?
কিশোর কুমার দাস: প্রথমত, বিদ্যানন্দের সঙ্গে আমরা যাঁরা জড়িত, তাঁরা সবাই নিজের কাছে নিজে জবাবদিহি করি। দেশের ৬০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের সদস্য হিসেবে আমাদের সবাই মনে রাখি কোন কাজটা করা উচিত আর কোনটা উচিত নয়। কোনোভাবেই যাতে আমাদের কোনো কাজ প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। আর টিমের সবার কাছে সবাইকে জবাবদিহি করতে হয়। মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সব সময়ই আমরা চাপের মধ্যে থাকি। জবাবদিহির বড় জায়গা হচ্ছে মানুষ। সেবাগ্রহীতার কাছেও বিদ্যানন্দের জবাবদিহি করতে হয়। রান্না করলাম অথচ রান্না ভালো হলো না, পরের দিন ঠিকই মানুষ এ নিয়ে কথা বলবে। আমরা অসচ্ছল মানুষের জন্য যে খাবার রান্না করি, ওই একই খাবার আমিসহ সব স্বেচ্ছাসেবক খাই, এই জবাবদিহির জন্যই।
প্রথম আলো: চট্টগ্রামের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগে স্নাতক শেষ করে এখন পেরুতে আবাসিক হোটেলের ব্যবসাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। দেশের বাইরে থেকে বিদ্যানন্দের বিভিন্ন দায়িত্ব কীভাবে পালন করছেন? গত বছর মে মাসে চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করারও ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কিশোর কুমার দাস: বিদ্যানন্দ আমাকে কেন্দ্র করে ঘোরে না। সহজভাবে বললে এটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্থা নয়। প্রসেস বা প্রক্রিয়া অনুযায়ী বিভিন্ন কাজ চলতে থাকে। এখানকার স্বেচ্ছাসেবকেরা শিক্ষিত, স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে অনলাইনেই বিভিন্ন বিষয়ে আমার আলাপ চলতে থাকে। গত বছর আমি আমার চেয়ার পদ থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলাম। এ নিয়ে মানুষ ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে থাকে, তাই পরে আর পদত্যাগ করা হয়নি।
প্রথম আলো: বিদ্যানন্দ কত দিন টিকে থাকবে বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইছি।
কিশোর কুমার দাস: বিদ্যানন্দ টিকে থাকবে এ চিন্তাটাই কখনো করি না। আমরা টিকে গেছি, তবে টিকে থাকতেই হবে এ চিন্তা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করি না। টিকে থাকার কৃতিত্বদাতা বা মানুষের। তবে একজন স্বেচ্ছাসেবক থাকলেও বিদ্যানন্দ তার কাজ চালিয়ে যাবে। সংস্থাটি তালাবদ্ধ করে বন্ধ করে দিতে হলে এই বন্ধ করার জন্য মানুষ যাতে কষ্ট পায় বা বিদায়টি যাতে জৌলুশপূর্ণ হয়, সে চেষ্টাটাকেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলা যায়। বিদ্যানন্দ যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হতে পারে। আমরা স্যানিটারি ন্যাপকিন, যৌনকর্মীসহ সমাজে যে ট্যাবু আছে, সে ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করি। তবে বিতর্ক বা সংস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা আমাদের দায়িত্ব থেকে সরে আসতে চাই না। বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ বন্ধ হবে না। আমরা বিশ্বাস করি, এক বিদ্যানন্দ বন্ধ হলে আরেক বিদ্যানন্দের জন্ম হবে।
প্রথম আলো: বিদ্যানন্দ নামটি নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন আছে। সব মিলে ব্যক্তি কিশোর কুমার দাস সম্পর্কে জানতে চাই।
কিশোর কুমার দাস: আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন বঞ্চনার মধ্যে বড় হয়েছি। টাকার জন্য লেখাপড়া প্রায় বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া—সব মিলে হতাশাগ্রস্ত ছিলাম। এসব থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলাম। বিদ্যানন্দ বিভিন্ন স্বপ্ন নিয়ে, নিজের স্বার্থে, নিজের ভালো লাগার জন্য শুরু করেছিলাম। তবে এটা এত বড় হবে সে চিন্তা মাথায় ছিল না। বিদ্যানন্দ নামটি দিয়েছেন একজন মুসলিম ব্র্যান্ড এক্সপার্ট—আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন, এ স্লোগান সামনে রেখে। প্রথম দিকে বিদ্যানন্দের সব আর্থিক জোগান পেরু থেকে আমিই দিতাম। এখন আর তা করতে হচ্ছে না। বিদ্যানন্দের লোগো লাগানো যে টি-শার্ট, তা–ও অনুদানে পাওয়া। আমার এক বোনও বিদ্যানন্দের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। মা, বাবা ও ভাইবোনেরা সবাই আমার প্রিয়। আমার বর্তমান স্ত্রী একজন লাতিন মেয়ে। তিনি খুব ভালো একজন মানুষ। আমরা নিঃসন্তান থাকার পরিকল্পনা করেছি। আমি যে কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি, তাতে নাড়ির টান না থাকাই ভালো। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন না যে আমি আমার বংশধরের জন্য টাকাপয়সা জমাচ্ছি। এই পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্তের জন্য আমার স্ত্রীকে অনেক ত্যাগস্বীকার করতে হয়েছে। দিন দিন মানুষ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে—ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়টি আমাকে কষ্ট দেয়।
প্রথম আলো: স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চরিত্র কেমন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন।
কিশোর কুমার দাস: করোনা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশাল সুযোগ করে দিয়েছে। এই সময়ে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভালো কাজ করেছে। তবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর বড় দুর্বলতা কাজে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে না পারা। করোনা শেষ হয়নি, তাই দুই দিন মানুষকে খাবার দিয়ে চলে গেলে চলবে না। এতে মানুষের আস্থা কমে যাবে। কাজটা করা দরকার বলেই করতে হবে। আর যাঁরা দাতা, তাঁদেরও মানুষের জন্য কিছু করা দরকার বলেই কাজটা করছেন, সেভাবে চিন্তা করতে হবে। মানুষের খাবার প্রতিদিনই দরকার—এটা চিন্তা করলে একবারে লোক দেখানোর জন্য কেউ দান না করে নিয়মিত দান করতে থাকবেন। কেননা দরকারটা এক দিনের নয়, প্রতিদিনের। আর সংস্থাগুলোতে যে স্বেচ্ছাসেবকেরা দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদেরও পার্থিব-অপার্থিব কোনো কিছু পাওয়ার আশায় কাজটা করা যাবে না।
প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কিশোর কুমার দাস: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।