>
- যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশে শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
- সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিকদের দেশে ফেরা বাড়ছে।
সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে অস্থিরতা বাড়ছে। সৌদি আরবে নিজস্ব লোকদের বিভিন্ন খাতে চাকরি দেওয়ার জন্য বিদেশি শ্রমিকদের দেশটি থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা বাড়ছে। দালাল চক্রের মাধ্যমে অভিবাসী শ্রমিকদের ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশের ঘটনাও বেড়েছে। লিবিয়াসহ বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শ্রমিকদের জন্য কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে শ্রমিকদের দেশে ফেরত আসার ঘটনাও বাড়ছে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের হিসাব বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, লিবিয়া, লেবাননসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ৪৯ হাজার ৩৭০ জন (নারী ও পুরুষ) শ্রমিক ফেরত এসেছেন। ২০১৬ সালে ৪১ হাজার ৬২৬ জন এবং গত বছর ৫০ হাজার ১৪৮ জন বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসেন।
চলতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে দল বেঁধে শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর ঘটনা বেশি ঘটছে। ফেরত আসা শ্রমিকদের খাদ্য, বাড়ি পাঠানোসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা দিচ্ছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। সংস্থাটি বলছে, চলতি বছরের ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে ৪০৮ জন, লিবিয়া থেকে ২২৪ জন, সিরিয়া থেকে ৯ জন এবং ইরাক থেকে ৪ জনসহ মোট ৭২৫ জন পুরুষ শ্রমিক দেশে ফিরেছেন।
১০ অক্টোবর বাংলাদেশের ৬৩ জন শ্রমিক মালয়েশিয়া যান। তবে ১১ অক্টোবর মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন থেকে এই শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো হলেও শ্রমিকেরা জানেন না তাঁদের অপরাধ কোথায়।|
১৫ অক্টোবর সৌদি আরবের দাম্মাম থেকে খালি হাতে ফেরত আসেন ১৯ জন নারী গৃহকর্মী। সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে আরেক নারী ফিরেছেন সন্তানসহ। মানিকগঞ্জের এক নারী গৃহকর্মীর কাজে জর্ডান যান। তবে এই নারীকে যৌন পেশায় বাধ্য করা হয়। তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে দেশে ফিরেছেন। সম্প্রতি এই নারী এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
দুই বছর লেবাননে কাজ করা সিলেটের আবু বকর প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশি দালাল শাহনাজ নামের এক নারীর পরামর্শে লেবানন থেকে তুর্কি হয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। তারপর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আট মাস জেল খেটে দেশে ফেরেন।
বিভিন্ন কারণে শ্রমিকেরা ফিরলেও সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বিষয়টিকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমবাজার স্বাভাবিক আছে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিকেরা ফেরত আসছেন বিষয়টি আমাদের নজরেও এসেছে। শ্রমিকেরা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করলে তখন জানা যাবে, কেন তাঁরা ফিরছেন।’
সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ২ লাখ ২০ হাজার শ্রমিক (নারীসহ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য গিয়েছেন। এই শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ১১২ দশমিক ৭২ কোটি টাকা। সরকারের এ সংস্থাটির ওয়েবসাইটে মোট কত শ্রমিক ফেরত আসছেন বা এসেছেন, সে তথ্য নেই।
সৌদি আরবের রিয়াদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দূতাবাসের নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন ১ হাজার ৯১৭ জন নারী গৃহকর্মী। এ ছাড়া ডিপোর্টেশন সেন্টার থেকে ১২ হাজার ৬৭০ জন কর্মীকে দেশে প্রত্যাবাসনে সহায়তা করা হয়। সৌদি আরবের জেদ্দায় শ্রম আদালতে মামলার মাধ্যমে ১ হাজার ৩১ জন কর্মীর বকেয়া বেতন–ভাতা আদায় করা হয়েছে। শুধু এ অর্থবছরে সৌদি আরব, কাতার, মালদ্বীপ, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশের কারাগারে বিভিন্ন অপরাধে আটক ছিলেন ৫ হাজারের বেশি শ্রমিক। বিভিন্ন দেশে ২ হাজার ৮৯৭ জন শ্রমিক মারা যান।
গত বছর ‘শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সুশাসন: সমস্যা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ার পাঁচটি ধাপে ১৬ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি শ্রম অভিবাসন খাতের সুশাসন নিশ্চিতে বিদ্যমান আইনের সংস্কার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বৈধ শ্রম অভিবাসনের বিভিন্ন বিষয় সংবলিত তথ্যের প্রচারসহ ৯ দফার সুপারিশ পেশ করে। ২০১৬ সালের মে থেকে গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এ গবেষণার তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, দালালের খপ্পরে পড়ে অনেকের বৈধ কাগজ থাকার পরও শ্রমিকেরা খালি হাতে ফিরছেন, সে চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশ এবং প্রচার হচ্ছে। বেসরকারি সংগঠনের পক্ষ থেকে বারবার বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় বসে আছে শ্রমিকদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার জন্য। অর্থাৎ মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে আমলেই নিচ্ছে না।
অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তারাই বলছেন, যে শ্রমিকেরা বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন, সেই শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি।