স রে জ মি ন ময়মনসিংহ ৩

বিতর্কিত সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যান

সাংসদ গিয়াস উদ্দিন ও ফাহমি গোলন্দাজ
সাংসদ গিয়াস উদ্দিন ও ফাহমি গোলন্দাজ

বর্তমান সরকারের আমলে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে ১০ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বদলি হয়েছেন। গফরগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বদল হয়েছেন আটবার।
এলাকায় ব্যাপক প্রচার আছে, বেশির ভাগ ইউএনও এবং ওসির বদলি হয়েছে স্থানীয় (ময়মনসিংহ-১০) সরকারদলীয় সাংসদ গিয়াস উদ্দিন আহমেদের ইচ্ছায়। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে তীব্র বিরোধ, প্রকাশ্যে গুলিবর্ষণ, বিরোধপূর্ণ জমিতে বাড়ি নির্মাণসহ নানা কারণে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত।
নানা অভিযোগ আছে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফাহমি গোলন্দাজের বিরুদ্ধেও। ক্যাডার লালন, সরকারি কর্মকর্তাকে মারধরের কারণে তিনি সমানভাবে বিতর্কিত।
ইউএনও এবং ওসিদের বদলির বিষয়ে সাংসদ গিয়াস প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন ইউএনও উত্তরা ষড়যন্ত্রের লোক ছিলেন। আমাকে না জানিয়ে গফরগাঁওয়ে দেওয়া হয়েছে বলে আমি পরিবর্তনের কথা বলেছি। অন্য ইউএনও এবং ওসি বদল হয়েছেন তাঁদের অদক্ষতার কারণে কিংবা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে।’
সাংসদ ও তাঁর অনুসারীদের যত কাণ্ড: সাংসদ হওয়ার আগে উপজেলা সদরে গিয়াস উদ্দিনের বাড়ি ছিল না। ২০১১ সালে উপজেলা সদরের ইমামবাড়ীতে ১০ শতাংশ জমির ওপর বাড়ি করেন। এলাকাবাসী জানান, ওই জমির মালিকানা নিয়ে মো. সিদ্দিকের সঙ্গে ছোট ভাই মো. মুজিবরের বিরোধ ছিল। সাংসদ জমি কেনেন মুজিবরের কাছ থেকে। সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, সেখানে তাঁর ৩৮ শতাংশ জমি ছিল। তিনি একাংশে কাঁচা ঘর তুলে ১৯৭২ সাল থেকে বাস করছিলেন। 

জমিটি নিয়ে ভাই মুজিবরের সঙ্গে বিরোধ হলে স্থানীয় লোকজন সালিস করে তাঁর পক্ষে রায় দেন। কিন্তু মুজিবর ২০১০ সালে জমির কিছু অংশ সাংসদের কাছে বিক্রি করেন। সাংসদ জমি কিনবেন শুনে তিনি সাংসদের বাড়িতে গেলে তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, তাঁর কাগজপত্র দেখেই জমি কিনবেন। কিন্তু কথা রাখেননি। মুজিবর তাঁকে উচ্ছেদ করে বাকি ২৮ শতাংশ জমি দখল করেছেন।

স রে জ মি ন ময়মনসিংহ ৩

এ বিষয়ে সাংসদ বলেন, দলিলসহ যাবতীয় কাগজপত্র যাঁর নামে, তাঁর কাছ থেকেই জমি কিনেছেন। মালিক দাবিদার অন্য কেউ তাঁর কাছে যাননি।
জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে উপজেলার ২২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ এনে সাংসদ ইউএনওকে ডিও লেটার (অনানুষ্ঠানিক চিঠি) দিয়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের বেতন-ভাতা স্থগিত করার পরামর্শ দেন। অভিযোগ রয়েছে, পছন্দমতো নিয়োগ না হওয়ায় তিনি এই চিঠি দেন। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাকে নিয়োগ দিতে হবে, কোন প্রতিষ্ঠানে বেতন বন্ধ থাকবে—সবকিছুতে ডিও লেটার দেন সাংসদ।
সাংসদের পক্ষের নেতা-কর্মীরা সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ৪১ শতাংশ জমিতে দলীয় কার্যালয় করেছেন। সওজ কয়েক দফা চিঠি দিলেও জমি দখলমুক্ত হয়নি। অবশ্য সাংসদ গিয়াস বলেন, এটি সওজের জায়গা নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যালয় ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা অন্যত্র কার্যালয় করেছেন।
গফরগাঁও রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দখল করে সাংসদের অনুগত পৌর ছাত্রলীগের নেতারা কার্যালয় করেছেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর ওই কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সাংসদের ছবিসংবলিত পোস্টার টানানো আছে। বসে আছেন ছাত্রলীগের নেতারা। অভিযোগ রয়েছে, ওই কার্যালয়ে বসে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করা হয়।জানতে চাইলে গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘এটা বাজারের জায়গা। ছাত্ররা মাঝেমধ্যে বসে।’
জানা গেছে, ২০০৯ সালের শুরুর দিকে সাংসদের ক্যাডাররা জাতীয় একটি দৈনিকের গফরগাঁও প্রতিনিধিকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। ওই বছরের জুলাইয়ে গফরগাঁও সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কামালউদ্দিনকে সাংসদের সামনেই তাঁর ক্যাডাররা লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনায় মামলা হয় এবং কলেজের শিক্ষকেরা কর্মবিরতি পালন ও কালো ব্যাজ ধারণ করেন।
সাংসদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের তীব্র বিরোধ: গফরগাঁওয়ে কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগ এখন চার ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন গিয়াস উদ্দিন, আরেক পক্ষে সাবেক সাংসদ আলতাফ হোসেন গোলন্দাজের ছেলে ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফাহমি গোলন্দাজ। এর বাইরে পৌরসভার মেয়র ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক কায়সার আহমেদ পৌর এলাকায় এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আলাল আহমেদ নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছেন।

চার পক্ষেরই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পৃথক কমিটি রয়েছে। বিভিন্ন কর্মসূচিও পৃথকভাবে পালিত হয়। তবে সাংসদ ও ফাহমির বিরোধ তীব্র। সাংসদ বিভিন্ন সময়ে প্রতিপক্ষের বাধার মুখে পড়েছেন, দুই পক্ষের মধ্যে মারামারিও হয় মাঝেমধ্যে।

২০১১ সালের মার্চে গফরগাঁও সরকারি কলেজের মাঠে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে প্রতিপক্ষের লোকজন সাংসদকে লক্ষ্য করে জুতা ছুড়ে মারেন। ২০১২ সালের মে মাসে উপজেলা সদরের কান্দিপাড়া বাজারে প্রতিপক্ষ সাংসদের গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়লে ক্ষুব্ধ সাংসদ নিজের পিস্তল দিয়ে গুলি ছোড়েন। ওই বছরের মার্চে যশরা ইউনিয়নের দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন উদ্বোধনের সময় দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। সাংসদের বহরে থাকা সাত-আটটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। গত ২৬ মার্চ ও ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ বেদিতে ফুল দিতে গিয়ে ফাহমির সমর্থকদের বাধার মুখে পড়েন সাংসদ। সেখানে দুই পক্ষের হাতাহাতিও হয়।

সাংসদ গিয়াস তাঁকে হত্যার চেষ্টা চলছে জানিয়ে নিরাপত্তা চেয়ে গত ২১ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কাছে চিঠি দেন। চিঠিতে এই হত্যাচেষ্টার তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে ফাহমি গোলন্দাজের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ফাহমির চাচাতো ভাই পরিচয়ে সাংসদকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি গফরগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সাংসদের ব্যক্তিগত সহকারী এ কে এম খাইরুল ইসলাম।

গিয়াস উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার উন্নয়নমূলক কাজে ঈর্ষান্বিত হয়ে আমাকে মারার জন্য ২০১২ সালে সড়ক অবরোধ করা হয়েছিল। ফাঁকা গুলি ছুড়ে সেবার বেঁচে গেছি। এখনো আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এটা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রেখেছি।’

বিরোধের বিষয়ে ফাহমি গোলন্দাজ জানান, তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছেন সাংসদের সমর্থিত প্রার্থীকে হারিয়ে। তিনি এবং সাংসদ দুজনই আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। আসলে দ্বন্দ্বের কারণ এ দুটি।

উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও আছে অভিযোগ: উপজেলা চেয়ারম্যান ফাহমির বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ২৪ জুন উপজেলা পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা জমির উদ্দিনকে মেরে দাঁত ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগে জমির পরদিন গফরগাঁও থানায় মামলা করেন। তবে ফাহমি বলেন, এটা মিথ্যা। মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

ফাহমির বিরুদ্ধে আছে ক্যাডার পালনের অভিযোগ। অভিযোগ আছে, তাঁর ক্যাডারদের হাতে সালটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুর রহমান এবং উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. ইসহাক লাঞ্ছিত হয়েছেন। ২০০৯ সালে বাংলাবাজার পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি ফরিদ আহমদকে কুপিয়ে আহত করে ফাহমির ক্যাডাররা।

পৌর মেয়র কায়সারের সমর্থকদের বিরুদ্ধে উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন ও কার্যালয় ভাঙচুর এবং পৌর মেয়রের বাসভবন ও কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ আছে ফাহমির ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে দুজনই দ্রুত বিচার আইনে পাল্টাপাল্টি মামলা করেন।

ক্যাডার পালনের অভিযোগের বিষয়ে ফাহমি বলেন, ‘আমার লোকজন আক্রমণের শিকার হলে তারা জবাব দেয়। এর বাইরে কিছু নয়।’